No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মল্লিকবাড়ি, জেব্রাগাড়ি আর একটা আত্মহত্যা

    মল্লিকবাড়ি, জেব্রাগাড়ি আর একটা আত্মহত্যা

    Story image

    হয়তো এসব গল্প  বিত্তের। অহমিকার। উত্তর কলকাতার পুরোনো ধামসা বাড়িগুলো সেই বিত্তের মূর্তিমান বিগ্রহ। হ্যাঁ, শিল্প নেই কি? আছে। তবে সে শিল্প উপচানো সম্পদ ছাড়া হওয়া মুসকিল। কিছু ব্যতিক্রম ছিল বৈকি। স্পষ্টভাবেই ছিল। তবে বিষয়টি জটিল। একদল বলবে, কলকাতার মহাজন, নিজেকে মহান জন প্রমাণের জন্য শুধু টাকার পাহাড় গড়ত না। সেইসঙ্গে জলসা বসাত, নাটক নভেল থিয়েটারের চর্চা করত। আবার বড়ো বাড়ি, বড়ো গাড়ির রেস লাগাত। বিত্ত, সেখান থেকে চুঁইয়ে পড়া আভিজাত্য। এমনকি তথাকথিত ভালো কাজ যেমন--হাসপাতাল নির্মাণ, পুকুর খনন-- তার ভিতরেও আভিজাত্যর গরিমা। আবার আরেকদল হয়তো বলবে, ট্রাজিডি। পুরোনো কলকাতার ইতিহাস জুড়ে এক গভীর ট্রাজিডি। অনেকটা গ্রিক নায়কের মতো।

    আমার কাজ অবশ্য দেখা। যেমন দেখে এলাম মল্লিকবাড়ি। চোখ ঝলসানো আভিজাত্যর আঁচটুকু নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে পাথুরিয়াঘাটার মল্লিক পরিবার। ৬৭ নম্বর পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিট

    এই বাড়িটির গ্রাউন্ড ফ্লোর রাস্তা থেকে প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু। ম্যাকিনটশ বার্ন নকশা করেছিল এই বাড়ির। সেই বার্ন-সাহেব, যিনি বিখ্যাত টেগোর ক্যাসেলেরও স্থপতি। সে যাহোক, এ মালিক ছিলেন যদুলাল মল্লিক। বাড়িটির অপূর্ব ঠাকুরদালানেই ভাবসমাধি পান শ্রীরামকৃষ্ণ। উত্তর কলকাতায় যদুলাল মল্লিকের অনেকগুলি বাড়িই ছিল। আজও আছে। তবে মূল বাড়ি এটিই।

    পাথুরিয়াঘাটা ঘাটা স্ট্রিটের মল্লিকবাড়ি

    পাথুরিয়াঘাটার গল্প শুরুর আগে আরেকটু গৌরচন্দ্রিকার অধ্যায় রয়েছে মল্লিকদের। সেটি বড়োবাজারে। সেই আদিপুরুষের নাম নিমাইচরণ মল্লিক। জন্মেছিলেন ১৭৩৬ সালে। নুনের একচেটিয়া ব্যবসা ছিল তাঁর। তাতে সেই আমলে লগ্নি করেছিলেন তিন কোটি টাকা। তৃতীয় মহীশূরের যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আটচল্লিশ লক্ষ টাকা ধার দিয়েছিলেন। যুদ্ধে জেতার পর লর্ড কর্নওয়ালিস তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন সোনার মেডেল। এই নিমাইচরণ মল্লিকের মৃত্যুতে তাঁর আট পুত্র আট লক্ষ টাকা খরচ করে কাঙালি বিদায় করেছিল। কাঙালির সংখ্যাও কলকাতায় তখন নেহাৎ কম ছিল না।

    নিমাইচরণের নাতি রামরতনের বিয়ে। সেই উপলক্ষে চিৎপুর অঞ্চলের দুই মাইল রাস্তা ভেজানো হয়েছিল গোলাপজলে। বিয়ের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা দেখতে লোকে নাকি এ-বাড়ি ও-বাড়ির মাথায়, কার্নিশে দাঁড়ানোর জন্য তিরিশ-চল্লিশ টাকার টিকিট কেটেছিল। অবশ্য তাতেও সুরাহা মেলেনি। আমাদের আজকের যে কার্নিভাল বেরোয়, তাকেও হারিয়ে দেবে সেসব জৌলুসের গপ্প। পদমর্যাদায় এঁরা নবাব ছিলেন না কেউ। এটা একটা মজা। কারণ, ১৭৫৭-এর পরে যে ক’টা বছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজা-নবাব এরা বেশ ছিল-টিল, তাদের সম্পদ কিস্যু নেই। কিন্তু নাম আছে। আর হাজার সম্পদ নিয়েও নবাব নয়- এমন উদাহরণও প্রচুর। তাই জনমানসে অন্তত নবাবি প্রতীতি তৈরি করতে, এরা খানিক বেশিই খরচ করেছিল আরকি।

    নিমাইচরণের এক পুত্র মতিলাল। তস্য পুত্র যদুলাল। অবশ্য দত্তকপুত্র।  পাথুরিয়াঘাটার মল্লিক বাড়ি মানেই যদুলাল বাবুর বাড়ি। ভালো মানুষই ছিলেন। বাগ্মী, পণ্ডিত মানুষ। রামকৃষ্ণদেব তো বটেই, ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গেও ছিল তাঁর ওঠা-বসা। ১৮৭৩ সালে কলকাতা মিউনিসিপালিটির কমিশনার মনোনীত হন। বারো বছর দক্ষতার সঙ্গে চালিয়েছিলেন সে কাজ। অস্বীকারের উপায় নেই, মল্লিক বাড়ির অনেক মানুষই নানাক্ষেত্রে এই শহরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য  করেছেন। যেমন রামগোপাল মল্লিক রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে। আবার রামগোপাল মল্লিকের নাতি দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক ভারতবর্ষে চিনা চায়ের পরিবর্তে দেশি চা প্রচলনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কুড়ি হাজার টাকা ব্যয়ে তৈরি করেছিলেন একটি আউটডোর বিভাগ। কলকাতা মেডিকেল কলেজেও তাঁর বিশেষ অবদান আছে। 

    প্রসন্ন কুমার স্ট্রিটের মল্লিক বাড়ি

    প্রমথনাথ মল্লিক ছিলেন কবি। আবার ইতিহাস রচনা করেছিলেন। খোদ কলকাতার ইতিহাস—‘কলিকাতার কথা’। সংস্কৃতিচর্চা তো ছিলই যদুলাল বাবুর বাড়িতে। আখড়াই, হাফ-আখড়াইয়ের আসর বসত। বিখ্যাত নিকি বাইজিরও মেহফিল বসত সেখানে। মোদ্দায় বিত্তবান সংস্কৃতিমনস্ক, রুচিশীল পরিবার।

    এতেই গল্পগুলো সুন্দর শেষ হতে পারত। কিন্তু হল না।  কাঁটা থাকবেই।

    মল্লিকবাড়ি বিখ্যাত ছিল খরচের জন্য। বিয়ে-অন্নপ্রাশন-শ্রাদ্ধের খরচ তো আছেই। এছাড়াও সীমাহীন খরচ। যদুলাল মল্লিকের ছোটো ছেলে মন্মথনাথ মল্লিক। নিজের ট্রটিং গাড়িখানার সঙ্গে তিনি বাহন জুড়েছিলেন দুটি জেব্রা। ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে পরিচিতি ছিল কলকাতাবাসীর। তা বলে, দিনেদুপুরে জেব্রা? জেব্রা ক্রসিং ক্রস করছে জেব্রায়? ভাগ্যিস, তখন জেব্রা ক্রসিং আসেনি। বেচারা জেব্রাগুলো বোমকে যেত নিশ্চিত। বহু কুলীন ঘোড়াও ছিল কিন্তু তাঁর সংগ্রহে। ঘোড়া না পেয়ে জেব্রা, এমনটা ভাবার কারণ নেই।  

    বিখ্যাত জেব্রা-গাড়ি

    জলযান হিসেবে ছিল ‘মল্লিকা’ নামধারী বজরা আর ‘মনোমত’ নামধারী মোটর লঞ্চ। বিলাসিতার বিবরণ লিখলে অবশ্য মহাকাব্যও হার মানবে।

    এই মন্মথনাথ মল্লিকের ভাইপো প্রদ্যুম্ন কুমার মল্লিক। খুল্লতাতকে নকল করলেও, তাতে আটকে থাকেননি। তাঁর নেশা ছিল বড়ো বাড়ি কেনায়। প্রাসাদোপম বাড়ি দেখলেই কিনে ফেলতেন। প্রচুর প্রচুর দামে। বহু সম্ভ্রান্ত বাড়ি, যেমন প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নাপতেহাটার বাড়ি, হরেন্দ্র শীলের বাড়ি (পরবর্তীতে লোহিয়া মাতৃভবন) কিনে ছিলেন। তার ওপরে তো ৩৫টি মোটর গাড়ি, ১০টি রোলস রয়েস। মানে সীমাহীন বিলাসিতা। 

    তবে এর শেষটা খানিক যন্ত্রণার। ঋণে জর্জরিত প্রদ্যুম্নবাবু তখন দেউলিয়া। অতএব উপায়? স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন মধুপুরের মার্বল হলে। আর নিলেন একটা রিভলভার। সেখানে গিয়ে প্রথমে স্ত্রীকে হত্যা। পরে আত্মহত্যা। একটা বেলাগাম জীবনের অবসান। 

    বিশ শতকে এসে বাঙালি ঠারেঠোরে বুঝছিল, তার নবাব-নবাব খেলার দিন শেষ হয়ে এসেছে। তারই উদাহরণ এই ঘটনা। তার পরপরই যে ভয়াবহ আত্মসংকটে সে পড়ে, আজও তার ভাগশেষ বয়ে বেড়াচ্ছে।

     

    (জেব্রা-গাড়ির ছবি ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত)

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @