চা-Talk প্রায় অহর নিশি

এই ধরাধামে সভ্যতার অগ্রগতিকে ত্বরাণ্বিত করেছিল চাকা, বেঁচে থাকায় বেশ একটা ধুম এসেছিল। তা, ‘চাকা’ এবং ‘বাঁচা'- দুয়েরই অর্ধেকটা জুড়ে চা টলটল করছে। বাঙালির জীবন চা-এ, চায় এবং এদিক-সেদিক পানে চায়। ভাবুন, শুধু উচ্চারণের দিকে কান পেতে রইলে সব এক। এবং কোনও এক মহাপুরুষের বাণী আমরা জানি- একতাই বল।
কিন্তু শুধু একতা-তেই জীবন লম্বা হবে না! মামণিকে বলো, বউ সন্টামণিকে বলো, বর্বর বরকে বলো, চা-দোকানের পটলা বা ফণিকেই বলো, কম প্ল্যান করে বলো কিংবা বাড়তি প্ল্যান করেই বলো, সকাল থেকে রাত অবধি একতা ছাড়াও আমাদের বহুবার ‘একটা চা বল’ বলতেও তো হয়। তারপর আবোল তাবোল চাবোল, যার জন্য ঠেকে পৌঁছতে হবে। বাঙালি আর কিছু পারুক না পারুক, চা-করিজীবী প্রত্যেকেই। বেকারত্বকে লাইক এবং কাঁচকলার দ্বৈত সম্মান! ‘চা' বলতে বলতে তার চাকরি চাওয়া, প্রেমিকার পানি চাওয়া, পকেটের মানি চাওয়া, জীবনে হয়রানি চাওয়ার ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। মানুষ নামক ঘোড়া ‘এক চা বল’-এর আস্তাবলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢুললেই, চা তাকে বল দেয়।
আর এই চায়ের সঙ্গে বলদায়ী ব্যাপার মানেই, কলকাতায় হরিশ মুখার্জী রোডে বলবন্ত সিংয়ের চা। ঝিল সাইজের ভাঁড়ে কানায় কানায় ভরা চা, আর তার ওপর ধোঁয়ার পাতলা চাদর। ওয়াহ! কোথায় তাজ, সুড়ুৎ আওয়াজে প্রাচীন দক্ষিণ কলকাতার ৯৭ বছরের আশ্চর্য এই প্রতিষ্ঠানের তরতাজ এবং দুধের সরতাজ আপনার জিভের টাকরায়।
শুধু তাই নয়, বলবন্ত সিংহের কেশর চা, কলকাত্মীয়জনের প্রাণের পানীয়। ভরা গ্রীষ্মে ‘দুধ-কোলা’ এঁদের অনন্য এক আবিষ্কার। বলা যায়, ঘাম চ্যাপচ্যাপ গরমে মানুষ যখন চা থেকে দূরে, অন্যান্য চা-দোকান ধুঁকছে, বলবন্তের সামনে তখন আদুরে চাপ্যায়নে দুধ-কলা দিয়ে চায়ের মহাকাল সাপোর্টার পোষা। দাঁড়িয়ে আড্ডা, ঠেস দিয়ে আড্ডা, গাড়ির ভিতর বন্ধুকে বসিয়ে আড্ডা চলছে, চলিতেছে। সারাটা বছর জুড়ে ভোর চারটে থেকে রাত আড়াইটে-তিনটে অবধি চা পেটানো চলছে। আর খাওয়ার শেষে ডাস্টবিন টিপ করে ভাঁড় থ্রো। এককথায় প্রকাশ করলে, এক্কেরে চা-থ্রো আন্দোলন। এমনই কৌশলে বানানো বলবন্তের চা, খাওয়ার শেষে দুধ-চা পানোত্তর মুখে টকস্বাদ কমাতীত কম, অ্যাসিডিটি নিপাত যাক। এত রাত অবধি চা, এই শহরের বুকে বলবন্ত সিংয়ের ঠেক যেন লালনের ভাষায়- চা-Talk প্রায় অহর নিশি…
আরও পড়ুন
অপুর সংসারে চপের সংসার
পরের লাইনে- চেয়ে আছে কালো শিশি। তার ভিতরে প্রজাপতি বিস্কুট ডানা ঝাপটে আপনার জিভে স্বাদের বিচিত্র রঙ সঁপে দিতে উতলা। সে শিশি খানিক দূরে রাখা। চেয়ে নিতে হবে। আর মূল আখড়ায়, এক বৃহৎ গামলা থেকে আরেক বৃহৎ গামলায় গরম চা শূন্যে দোলাচ্ছেন চা-স্পেশালিস্ট অক্ষয়কুমারসুলভ এক মূর্তিমান। সেই মাটি রঙ পানীয় আপনার গলায় যেতে, আপনার অন্তঃস্তল বিশ্বরূপ দর্শন করবে। সারাদিনে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার ভাঁড় পড়ে ডাস্টবিনে। নিন্দুকেরা বলবে- ভাঁড়ামো হচ্ছে! অদৃষ্টের হাতে লেখা বলবন্তের খ্যাতির ভাঁড়, ইহা কিঞ্চিত।
কত কী বলার ছিল যে
If চা comes, can টা be far behind?
ব্যবস্থা আছে। চায়ের ঠেক হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, বলবন্তের ছাদের তলায় খাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু। কী নেই সেখানে। সকালের শিঙাড়া, কচুরী থেকে উত্তরের ডাল মাখানি, দক্ষিণের ধোসা, ইডলি। কলকাতার প্রথম নিরামিষাশী এই হোটেল সেই কবে থেকে আমিষাশীদেরকেও নিরামিষের জিভসেবায় শাসিয়ে চলেছে। গন্তব্য এবার রাত গড়ালে বলবন্তব্য যে হতে হবেই, তা নিয়ে আর কোনও মন্তব্য আছে কি?