No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বিবেকানন্দ, সত্যজিৎ ম্যাজিক জানতেন, কেশবচন্দ্রের ‘ম্যাজিক শো’ দেখতেও ভিড় হয়েছিল ভালোই  

    বিবেকানন্দ, সত্যজিৎ ম্যাজিক জানতেন, কেশবচন্দ্রের ‘ম্যাজিক শো’ দেখতেও ভিড় হয়েছিল ভালোই  

    Story image

    আগ্রার মসনদে তখন জাহাঙ্গির। একদিন সাতজন বাজিকর এলেন তাঁর দরবারে। সবাই সুদূর বঙ্গদেশ থেকে এসেছে। সবমিলিয়ে আটাশটি জাদুর খেলা দেখিয়েছিল সেই বাজিকরের দল। অবিশ্বাস্য সব জাদু। জাহাঙ্গিরের সভাসদ খান-ই-জাহান এক-একটি গাছের নাম বলছেন, আর সেইসব বাজিকরেরা তৎক্ষণাৎ বীজ ছড়িয়ে মন্ত্র পড়ে জন্ম দিচ্ছে সেইসব গাছের। গাছেরা চোখের সামনেই হুহু করে বেড়ে উঠছে। ফল হচ্ছে। সেই ফল চেখে মুগ্ধ হচ্ছেন নবাব স্বয়ং। দরবারময় উড়ে বেড়াচ্ছে রং-বেরঙের পাখি। ‘জাহাঙ্গিরনামা’-য় বাংলাদেশের বাজিকরদের নিয়ে তাই একখানা গোটা অধ্যায় লিখেছেন নবাব। বলেছেন, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হত না, এমন অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানা কোনো মানুষ ঘটাতে পারে! 

    এসব অবশ্য ষোলো-সতেরো শতকের কথা। বাংলার বাজিকরদের দল তখন গোটা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁদের জাদুতে সবাই বুঁদ। তারপর সময় গড়াল অনেকটাই। লালমুখো সাহেবরা এল। বিলিতি আধুনিকতাও এল। বাংলার পরিযায়ী বাজিকরদের সঙ্গে ‘শিক্ষিত’ যুবসমাজের সম্পর্ক ক্ষীণ হতে লাগল। তখন বরং হাওয়া-বাতাসে উজিয়ে আসে পাশ্চাত্য জাদুর কথা। সেই জাদুকে বলে ‘ম্যাজিক’। বাংলা ‘ইন্দ্রজাল’ শব্দটা তখনো এত পরিচিত হয়নি। পথে-ঘাটে নয়, মঞ্চের আলো-আঁধারিতে হয় সেইসব জাদুর প্রদর্শন। হলই বা অন্য জাতের জাদু, বাঙালি এতেও বুঁদ হল। তাঁদের জিনেই জাদু। উনিশ শতকের শেষ দুই-তিন দশক থেকেই ম্যাজিক নিয়ে বাঙালির উৎসাহ তুঙ্গে। বিশ্বখ্যাত সব বাঙালি জাদুকরদের কথা ছেড়েই দিলাম, বাংলাদেশের অন্যান্য বহু রথী-মহারথীরাও ম্যাজিকের নেশায় জড়িয়ে পড়লেন। বিবেকানন্দ, কেশবচন্দ্র সেন, সত্যজিৎ রায়, গিরীন্দ্রশেখর বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় কিংবা বর্তমানে ভগীরথ মিশ্র—সেই তালিকা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো!

    ‘জীবনস্মৃতি’-তে এক ম্যাজিশিয়ান সহপাঠীর কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে নিজেই নিজের নামের আগে ‘প্রফেসর’ জুড়েছিল। আর জুড়েছিলেন হরীশচন্দ্র হালদার ওরফে হ চ হ। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন- ‘একমাথা টাক। তাঁর তাক লাগিয়ে দেবার রকমটা ছিল আলাদা।... পালা জমাতে এলেন প্রোফেসর হরীশ হালদার। নামের গোড়ার পদবীটা তাঁর নিজের হাতেই লাগানো।’ এই ‘প্রফেসর’ পদবির প্রতি লোভ তখন বহু বাঙালির। সেই কবে প্রিয়নাথ বসুর তত্ত্বাবধানে একদল বাঙালি ব্যায়ামবিদের প্রদর্শনী দেখে বড়লাট লর্ড ডাফরিন মুগ্ধ হয়ে প্রিয়নাথকে সম্বোধন করেছিলেন ‘প্রফেসর বোস’ নামে। তারপর থেকেই হয়তো এই সম্বোধনকে ভালোবেসে ফেলল বাঙালি। ম্যাজিক দেখাতে জানলে তো এই ‘পদবি’-র ওপর আরোই অধিকার জন্মায়। সে-যাহোক, রবীন্দ্রনাথ নিজে ম্যাজিক নিয়ে মাতেননি। কিন্তু শান্তিনিকেতনে তাঁকে ম্যাজিক দেখিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান গণপতি। 

    তবে, বিবেকানন্দ ম্যাজিক-চর্চা করতেন কিশোর বয়স থেকেই। তাঁর ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখে গেছেন, ‘দাদা’ নরেন্দ্রনাথের সেই জাদু-বিদ্যের কথা। ছোটো ছোটো ভাইবোনদের অবাক করে দিতেন ম্যাজিক লণ্ঠনের খেলা দেখিয়ে। এমনকি, পরবর্তীকালেও গুরুভাই ও শিষ্যদেরও জাদু দেখাতেন বিবেকানন্দ। আর, ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম স্থপতি কেশবচন্দ্র সেন তো রীতিমতো ‘শো’ দেখিয়েছিলেন ম্যাজিকের। অনেকে এক আনার টিকিট কেটে সেই ম্যাজিক শো দেখতে গিয়েছিল কলুটোলার বাড়িতে। 

    কেশবচন্দ্র তখন নেহাতই ছেলেমানুষ। হিন্দু কলেজ থিয়েটারে মিঃ গিলবার্ট নামের এক ফিরিঙ্গি ম্যাজিক ল্যান্টার্ন আর অন্যান্য ম্যাজিক দেখাতেন। ম্যাজিকের টানে কয়েকবার সেই খেলা দেখতে গেছিলেন কেশবচন্দ্র। বাকিরা সাহেবের জাদু দেখে ব্যোমকে গেছে, কিন্তু মেধাবি কেশবচন্দ্র ধরে ফেললেন গিলবার্টের হাতসাফাই। বাড়িতে এসে কয়েকদিনের প্র্যাকটিসেই জাদু হাতে ধরা দিল। এরপর কেশবচন্দ্র বিজ্ঞাপন দিলেন ‘ম্যাজিক শো’-র। দর্শকরা ওইটুকু ছেলের ম্যাজিক দেখে অবাক! মোমবাতি কেটে তার ভিতর থেকে রুমাল বের করছে সে, কাঁচের গ্লাসের জল হয়ে যাচ্ছে ফুলের পাপড়ি! বলাই বাহুল্য, ম্যাজিশিয়ান হলেও বেশ বিখ্যাত হতেন কেশবচন্দ্র।

    যেভাবে ম্যাজিককে পেশা হিসেবে নিলে যথেষ্টই নাম করতেন বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ গিরীন্দ্রশেখর বসুও। ‘যোগী গিরীন্দ্রশেখর’ নামে মঞ্চে ম্যাজিক দেখাতেন ছাত্র-বয়সে। তাঁর টাকার খেলার প্রশংসা করে গেছেন মার্কিন জাদুগর নেলসন ডাউসনও। আর বিখ্যাত সেতারশিল্পী বিমলাকান্ত রায়চৌধুরীর ম্যাজিক-প্রতিভা নিয়ে পিসি সরকার বলেছিলেন, “বিমলাকান্ত পেশাদার জাদুকর হলে আমার ভাত মারা যেত।” বিলায়েত খাঁ, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়দের গুরু বিমলাকান্ত খেলা দেখাতেন ‘বিকেআর’ নামে। মঞ্চে আসতেন সুট-বুট পরে সাহেব সেজে। হঠাৎ দপদপ করতে করতে নিভে যেত মঞ্চের আলো। দু-তিন সেকেন্ডের মধ্যে ফের আলো জ্বলে উঠতেই সবাই দেখতেন ছেঁড়া পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে নিখিলবাবু একই জায়গায় দাড়িয়ে।

    এক বিয়ে বাড়িতে একজন বাঙালি ম্যাজিশিয়ানের ম্যাজিক দেখে তাক লেগে গেছিল সত্যজিৎ রায়ের। তারপর, যাকে বলে ম্যাজিকের নেশা লেগে গেল। একদিন সেই ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে আবার দেখা বকুলবাগান আর শ্যামানন্দ রোডের মোড়ে। সত্যজিৎ আবদার জুড়লেন ম্যাজিক শেখার। সেই ভদ্রলোক রাস্তায় দাঁড়িয়েই তাসের ম্যাজিক শিখিয়ে দিলেন সত্যজিৎকে। সেই শুরু। ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইতে সত্যজিৎ লিখছেন, ‘পরে ম্যাজিকের বই কিনে হাত সাফাইয়ের অনেক ম্যাজিক আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেই অভ্যাস করে নিয়েছিলাম। কলেজ অবধি ম্যাজিকের নেশাটা ছিল।’ সত্যজিতের লেখায়, সিনেমায় তাই ফিরে ফিরে আসে ম্যাজিকের অনুষঙ্গ। কৈশোর-যৌবনের প্রেম কি ভোলা যায় সহজে!

    ম্যাজিকে এভাবেই বুঁদ ছিলেন চিকিৎসক প্রভাতকুমার চট্টোপাধ্যায়, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রপরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-এর মতো মানুষরাও। ব্যায়ামবীর বিষ্ণুচরণ ঘোষ পেশিপ্রদর্শনীর মধ্যেই জুড়ে দিতেন ম্যাজিকের খেলা। ‘জাদূগর’-এর লেখক ভগীরথ মিশ্র ছোটোবেলায় পালিয়েছিলেন এক ‘কালান্দার’-এর হাত ধরেই। একটা সময়ে তিনি জাদুর খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন, সঙ্গে থাকত প্রশিক্ষিত কুকুর রোবট। ম্যাজিক এঁদের কারো প্রধান পেশা ছিল না। কিন্তু মঞ্চে উঠে তাক লাগিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল অনেকেরই। এ যেন একটা উত্তরাধিকার। বাজিকর, কালান্দারদের জাদু কিংবা পাশ্চাত্য ‘ম্যাজিক’—বাঙালি সবটাকেই চেটেপুটে নিয়েছে। এই জাতটার জিনেই বোধহয় বোনা আছে—ম্যাজিক!     

    তথ্য-ঋণ: জাদুসম্রাট গণপতি ও বাঙালির জাদুচর্চা, সমীরকুমার ঘোষ      
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @