বাংলার মাদুর বোনার কড়চা

মাদুর কাঠির চাষ করেন পুরুষ আর মাদুর বোনেন মহিলারা। এখানেই তৈরি হয় দু’টি মনন জুড়ে একটি রঙিন শিল্প। বাংলার মাদুর শিল্পের সমাদর সর্বত্র। আমরা যে মাদুর দেখি কার্যত তার বুনন দু’রকমের। যথা – একহারা ও দোহারা। একহারার দু’টি কাঠি সুতোর উপর নিচে পরানো হয় পর্যায়ক্রমে। আর দোহারার দু’টি কাঠি দু’টি দড়ির ওপর নিচে পরানো হয়। অনেক সময় মাদুরের ঘের বড় করার জন্য কাপড় দিয়েও ছোট ছোট দু-তিনটে মাদুর জোড়া লাগানো হয়।

তবে আজকের গ্লোবাল যুগে দেশী মাদুর কাঠির বাজার নিচ্ছে প্লাস্টিকের মাদুর কাঠি। তাই প্লাস্টিকের সস্তার মাদুরে বাজার ছেয়ে গেছে। স্বভাবতই লোকশিল্পের কাঠি মাদুরের নমুনা খুঁজে পাওয়া ভার। তাই এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে পশ্চিমবঙ্গে মাদুর শিল্পের লৌকিক চরিত্রের এক ধরনের অবনতি ঘটছে। তবে সেই লৌকিক চেহারাকে ধরেও রাখার চেষ্টা করছেন অনেকেই।
পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় মাদুর তৈরি হলেও মেদিনীপুর জেলাই হল এই শিল্পের পীঠস্থান। মেদিনীপুরের সবং থানার তালদা, দাঁতড়দা, সারতা, দাঁড়রা, পাঁশকুড়ার রঘুনাথবাড়ি, ময়না, রামনগরের কচুড়ি, সাদি, হলদিয়া, পুরুষোত্তমপুর, বেতেশ্বর, খোলাবেড়িয়া, চন্দনপুর, এগরা অঞ্চলে মাদুর তৈরি হয় ঘরে ঘরে। তা ছাড়া মাদুর তৈরি হয় কোচবিহারে, বীরভূমের শ্রীনিকেতনে, হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুর, আমতা এবং উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার বেশ কয়েকটি জায়গায়।

এমনিতে একহারা ও দোহারা মাদুর প্রায় সব জায়গাতেই তৈরি হলেও বাংলার বিশেষ জাতের ‘মসলন্দ’ মাদুর তৈরি হয় পূর্ব মেদিনীপুর জেলার রামনগরে এবং সবং অঞ্চলে। রামনগরের খোলাবাড়িয়া গ্রাম ‘মসলন্দ’ মাদুরের জন্য বেশ বিখ্যাত। সে কারণেই মাদুর শিল্পের জন্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলার রামনগরের তো খুব নামডাক। মাদুরকে এখানে পল্লীবাসীরা তাদের ভাষায় বলেন ‘মশনা’। এ ছাড়াও রামনগরের এক নম্বর ব্লকের সাদি, খয়রান্ডা, হলদিয়া আর দু’নম্বর ব্লকের সাবিত্রাপুর এবং দেপাল প্রভৃতি গ্রামে মাদুর তৈরি হয়।

বর্তমানে খোলাবাড়িয়া গ্রামে আছে ‘মাদুরম সমিতি’। এই গ্রামের প্রায় পঁচিশ জন শিল্পী মাদুর শিল্পের কাজে যুক্ত। দু’টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী ‘অন্নপূর্ণা স্বনির্ভর দল’ এবং ‘যশোদা স্বনির্ভর দল-র সদস্যরা দক্ষতার সঙ্গে এখানে কাজ করছেন। মাদুর শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন নমিতা গিরি (৩৫), যশোদা দাস (৫৫), মালতী পাল (৪৫), শিউলি পালদের (২৮) মতো অনেকেই। এই সব শিল্পীরা হাতে বোনা মাদুরের রং-বাহারি নকশা যেমন- পাখি, চাঁদ-তারা, কলকা, পান পাতা, চৌকোনাতে রাঙা দেখলে মন ভরে যায়। দেখে মনে হয় যেন তাঁতে বোনা কাপড় দেখছি। মাদুরের নকশায় আবার হাজির হয় বাংলার পুরোন কাব্য গল্প। কখনও থাকে রাধা-কৃষ্ণের লীলা, কখনও বা রাম-রাবণের যুদ্ধ ইত্যাদি। মাদুর বোনার সঙ্গে তাঁত বোনার বেশ মিল। আবার মাদুরের নক্সা দেখলেই মনে পড়তে পারে কাঁথার নক্সার কথা।

খোলাবেড়িয়া গ্রামের কোনও কোনও শিল্পী জেলার বাইরেও মাদুর শিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যেমন, উত্তর ২৪ পরগণার গোবরডাঙা, বর্ধমানের পূর্বস্থলী প্রভৃতি জায়গায় প্রশিক্ষক হিসাবে গিয়েছিলেন এখানকার খগেন্দ্রনাথ প্রধান। এই শিল্পী ডিস্ট্রিক্ট কটেজ অ্যান্ড স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রিজ অব ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। নিউ দিল্লিতে শিল্প প্রদর্শনীতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর তৈরি তালপাখা, মাদুর উপহার দিয়েছিলেন। ক্রাফট কাউন্সিল অব ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে আমেরিকা এবং আরব যাওয়ার প্রস্তাব এসেছিল তাঁর কাছে।

খগেন্দ্রনাথ প্রধানের মত খোলাবেড়িয়া গ্রামের সরযূবালা গিরি দিল্লির প্রদর্শনীতে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮৮ সালে। এ সব শিল্পীর নকশার কাজ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আসলে মাদুর বিছিয়ে শোয়া কিংবা অতিথিকে বসতে দেওয়া অথবা ঘরোয়া অবসর কাটানোর রেওয়াজের সঙ্গে শিল্পবোধকে মিশিয়ে দিয়েছেন এই মাদুর শিল্পীরা। তাই দেখা যায় কখনও ঘরে দেখা কাঁথা বা তাঁতের কাপড়ের নকশাকে তাঁরা তুলে নিচ্ছেন মাদুরে আবার কখনও বা পাঁচালিতে শোনা রামায়ণের কাহিনি বা কীর্তনে শোনা কৃষ্ণলীলার কাহিনিকে মাদুরে জুড়ে দিচ্ছেন পরম যতনে। এসবের সঙ্গে আসলে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় লোকায়ত স্তরের মানুষের শিল্পবোধ আর সেই সঙ্গে গৃহস্থের মঙ্গল কামনার চিন্তাসূত্র। এসবের খোঁজ নাগরিক সমাজ রাখে কই? কিন্তু এটাই চিন্তার বিষয় যে বর্তমানে প্রকৃতিজাত জিনিসের থেকেও প্লাস্টিকের কদর বেশি। দাম দর এবং যোগানে সস্তা হয়,রঙ-চঙে হয়, স্থায়ী হয় আর চাহিদাও বেশী।

দীঘা এখান থেকে দূর নয়। এখানে এখন প্লাস্টিকের সস্তা মাদুর পাওয়া যায়। তাই এখানে আসা ট্যুরিস্টরা অনেকে মাদুর কাঠির মাদুর খোঁজেন না। তবে গ্রামে বিয়ের মরসুমে মাদুর কাঠি দিয়ে তৈরি মাদুর বিক্রি হয়। শ্রাদ্ধ-শান্তিতেও ব্রাহ্মণদের মাদুর কাঠি দিয়ে বোনা মাদুর দেওয়ার চল আছে। আর পুজোর আচারে তো প্লাস্টিকের মাদুর চলবে না। তাই মাদুর কাঠির মাদুরের একটা আলাদা কদর আছে গ্রাম সুবাদে। সব করেও একটা মাদুরে বেশি লাভ হয় না। তবে কী বাড়ির সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারেন। মূলত মাদুর কাঠির চাষটা করেন বাড়ির পুরুষেরা আর মাদুর বোনার কাজটা করেন মহিলারা। গরিব সংসারে পুরুষ-মহিলার যৌথ উদ্যোগে সংসারতরী বইতে থাকে আপন গতিতে। এটাই এই শিল্পের মজা।