মাদ্রাসা কেবল মুসলমানের নয়, পাটনার মাদ্রাসায় পড়েছিলেন খোদ রামমোহন

কথায় প্রচলিত আছে, কোরান অবতীর্ণ হয়েছে মক্কায়, তাকে সুর করে পড়তে শিখিয়েছেন মিশরীয়রা এবং কোরানকে গবেষণা করে মগজে ধারণ করেছেন ভারতীয়রা। শত শত বছর ধরে মাদ্রাসাগুলি আমাদের উপমহাদেশে কোরান চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। কেবল ধর্মীয় শিক্ষা নয়, চিকিৎসাবিদ্যা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, গণিত, সাহিত্য, যুক্তিবিদ্যা, ব্যবসা-বাণিজ্য – নানা কিছুর পাঠ দিত মাদ্রাসা। অথচ অভিযোগ তোলা হয়, মাদ্রাসা নাকি সন্ত্রাসবাদী তৈরির কারাখানা। সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ানো হয় সেখানে।
এইসব অভিযোগ কতটা যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত? বরং পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মাদ্রাসা কেবল মুসলমানদের নয়। গত বছর আমাদের রাজ্যে মাদ্রাসা বোর্ডের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় বসেছিল প্রায় ৭০ হাজার পড়ুয়া। তাদের মধ্যে ১৮ শতাংশই হিন্দু। পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা এডুকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু তাহের কামরুদ্দিনদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুরুলিয়া, বীরভূম ও বাঁকুড়ায় ৪টি বড়ো মাদ্রাসা রয়েছে। যেখানে অমুসলিম পড়ুয়াদের সংখ্যা মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের থেকে বেশি।
তার আগের বছর ২০১৯ সালে এরাজ্যে মাদ্রাসা বোর্ডের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিল ১২.৭৭ শতাংশ অমুসলিম। যা খানিকটা বেড়েছে ২০২০ সালে। এর কারণ হিসেবে শিক্ষাবিদরা মনে করেন, রাজ্য সরকারের মধ্যশিক্ষা পর্ষদের স্কুলগুলিতে পড়ুয়ার সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। তাই গ্রামেগঞ্জে অনেক অভিভাবকই সন্তানদের ভর্তি করছেন মাদ্রাসায়।
কেবল ভর্তি নয়, পড়াশোনায় কৃতিত্ব রাখতেও দেখা গিয়েছে অমুসলিম পড়ুয়াদের। ২০১৭ সালে হাই মাদ্রাসার দশম শ্রেণীর পরীক্ষায় রাজ্যের মেয়েদের মধ্যে তৃতীয় এবং সর্বোপরি রাজ্যের মধ্যে অষ্টম স্থান অধিকার করে তাক লাগিয়ে দেয় উদয়নারায়ণপুরের খলতপুর হাই মাদ্রাসার ছাত্রী প্রশমা শাসমল। গত বছরই মাদ্রাসা বোর্ডের দশম শ্রেণির পরীক্ষায় ষষ্ঠ হয়েছে খণ্ডগ্রাম ডিএস হাই মাদ্রাসার ছাত্র জগন্নাথ দাস।
ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করার পর এখানে তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই বাংলায় মাদ্রাসা গড়ে উঠতে থাকে। মধ্যযুগ থেকেই অমুসলিমরা মাদ্রাসায় গিয়ে পড়াশোনা করতে পারতেন। ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ যাকে বলা হয়, সেই রাজা রামমোহন রায়ও পাটনার এক মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে আরবি এবং ফার্সি শেখেন। এছাড়া সংস্কৃত, ইংরেজি, গ্রিক এবং হিব্রু ভাষাতেও পারদর্শী ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করে ইংরেজ সরকার। এখন মাদ্রাসা এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সিলেবাসে পার্থক্য খুবই কম। মাদ্রাসা বোর্ডের দু’টি শাখা রয়েছে। একটি হাই মাদ্রাসা, যেখানে আরবি ভাষা ঐচ্ছিক। আর সিনিয়র মাদ্রাসাতে দেওয়া হয় ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান। অমুসলিম পড়ুয়ারা সাধারণত হাই মাদ্রাসাকেই বেছে নেয়। বহু সংখ্যক অমুসলিম শিক্ষকও পাঠ দেন মাদ্রাসায়।