No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : শঙ্খমালা

    ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : শঙ্খমালা

    Story image

       গত পর্বের পর   

    ফোনে অ্যালার্ম  অথবা কানে তুলো কোনোটারই দরকার ছিল না। গানের গুঁতো আর কুলেব্রায় একটা টাটকা দিনের জন্ম দেখার অধীর আগ্রহে ঘুমের টিকিটিও দেখা যায়নি সে রাতে। চারটে নাগাদ উঠে, পা টিপে টিপে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাথরুমে গিয়ে ঢোলগোবিন্দকে এ যাত্রার মতো অবসর দিয়ে চটপট তৈরি হয়ে নিলাম।

    “সুপ্রভাত জেনিফার.. ওঠ...এবার বেরোতে হবে ”
    “সুপ্রভাত”

    জেনিফার বাথরুমে গিয়ে খুব জোরে কল খুলে দিল। আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। গতকাল রেস্তোরাঁয় পরিবেশিকাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই দ্বীপে কোথা থেকে সবচেয়ে ভালো সূর্যোদয় দেখা যাবে৷ মিষ্টি হেসে মেয়েটি আমাদের সেই পথ বাতলে দিয়েছিল।

    অন্ধকার থাকতেই আমি আর জেনিফার রাস্তায় নামলাম। লাল সেলামের গায়ে রাতের শিশির পড়েছে। রাস্তাঘাট শুনশান। কারাওকে গায়কের দল শেষরাতে ঘুমিয়েছে। তাদের ঘুম ভাঙতে এখন ঢের দেরি। লাল সেলাম অল্প আড়মোড়া ভেঙে আমার নির্দেশে সাড়া দিল। মামাসিটাস গেস্ট হাউস থেকে প্রথম ডানদিক ঘুরলেই একটা ছোটো কাঠের পাটাতন দেওয়া ব্রিজ... নিচে সাগর থেকে বিছিন্ন এক বিরহী জলপ্রণালী... তারপরেই একটা বাঁদিক নিলেই প্রথমে এল ইডেন রেস্তোরাঁ... তারপর ভিলা বোহেমে... পুবের আকাশে অল্প ফরসা ভাব। আমার বাঁদিকে এনসেনেদা হন্ডা... এই দ্বীপের সবচাইতে বড়ো জেটি এলাকা। ক্যারিব সাগরের জল এখানে লক্ষ্মী মেয়ের মত চুপটি করে বসে রয়েছে... কোনোরকম দস্যিপনা নেই তার। তাকে চারিদিকে অভিভাবকের মতো ঘিরে রয়েছে কুলেব্রা দ্বীপ। লোকে বলে যে গোটা ক্যারিবিয়ানে নাকি এনসেনেদা হন্ডার মতো এত সুরক্ষিত বন্দর আর নেই। অন্য যেখানেই আবহাওয়া বিপর্যয় হোক না কেন... এই শান্ত মেয়েটিকে কোনো ঝড় কোনোদিন বিপদে ফেলতে পারবে না।

    অন্ধকার থাকতেই আমি আর জেনিফার রাস্তায় নামলাম। লাল সেলামের গায়ে রাতের শিশির পড়েছে। রাস্তাঘাট শুনশান। কারাওকে গায়কের দল শেষরাতে ঘুমিয়েছে। তাদের ঘুম ভাঙতে এখন ঢের দেরি।

    জলের একেবারে পাশ দিয়ে চলেছে লাল সেলাম। দূরে পাহাড়ের আড়ালে একটা দিনের জন্মমূহূর্ত আগত। এবার ডানদিকে ভিলা প্যানোরামা... কাছেই কোথাও একটা মোরগ ডেকে উঠল... আমি আর জেনিফার এই অসামান্য সৌন্দর্যের মহানুভবতায় নিশ্চুপ... নতজানু। আর ঠিক তখনই... আমাদের পথ আটকে এনসেনেদা হন্ডার জলে সোনার প্রদীপ জ্বালিয়ে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালেন বিভাবসু।

    মুগ্ধ হলাম...

    খানিক বাদে ডানদিকে পড়ল ক্লাব সীবোর্ন হোটেল। এই দ্বীপের সবচেয়ে অভিজাত আস্তানা। সেখানে কাঁঠালি চাপা ফুটে রয়েছে৷ তার হালকা সুবাস বইছে ভোরের বাতাস। কোথাও কোনো জনমানব নেই... সমস্ত দ্বীপ যেন ঘুমের কাঠি ছোঁয়ানো রাজকন্যে। লাল সেলামে সওয়ার, অচিন দেশে, এক নীল পোশাকের মানুষের ঠাকুমার ঝুলি মনে পড়ে...

    “খোক্কস বলিল... বঁটে! ঘঁরে কেঁ জাঁগে? যত খোক্কসে কিচিমিচি... কেঁ জাঁগে? কেঁ জাঁগে?

    লালকমল উত্তর করিলেন -

    নীলকমলের আগে লালকমল জাগে
    আর জাগে তরোয়াল
    দপ দপ করে ঘিয়ের দীপ জাগে
    কার এসেছে কাল?”

    যেতে যেতে যেতে যেতে... এক সময় জলের কিনারে রাস্তা শেষ হয়ে গেল। সামনে আর পথ নেই... স্থল নেই... যতদূর চোখ যায় সোনার রঙে রাঙানো ক্যারিব সাগর। আমি আর জেনিফার সেই সীমারেখায় এসে খানিক সময় দাঁড়িয়ে রইলাম।

    মোরগ ডাকছে... গাছের পাখিরা নতুন দিনের জন্য প্রস্তুত... কয়েকটা প্রজাপতি দিশেহারার মতো উড়ে বেড়াচ্ছে ইতস্তত... হঠাৎ মাটির দিকে তাকিয়ে দেখি একটা শামুক হেঁটে হেঁটে চলেছে। সাদা কালো ফুটকি দেওয়া গায়ের রং একেবারে পথের সঙ্গে মিশে রয়েছে। চলাফেরা না করলে ঠাহর করতে পারতাম না। কিন্তু শামুকের তুলনায় এটির গতিবেগ যথেষ্ট দ্রুত। আস্তে করে শামুকেটাকে উল্টে দেখি... তার পেটে লাল রঙের দাঁড়া... সেটিকে যে চট করে গুটিয়ে নিচ্ছে সে মোটেও শামুক নয়... শামুকের খোলে আশ্রয় নেওয়া অনুপ্রবেশকারী হার্মিট ক্র্যাব। কাগবগের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য এক অসাধারণ বর্মধারণ।

    লাল সেলাম এবার ফিরতি পথে। বেশ খিদে পেয়েছে দুজনার৷ শহরে ফিরে কোথাও একটা সকালের  চা জলখাবার সারতে হবে৷ তারপর শেষবারের মতো মামাসিটাস গেস্ট হাউসে ফিরে, স্নান সেরে, ঘর ছেড়ে দিযে এই দ্বীপের বাকিটুকু দেখে নেওয়া। জেনিফার এখন চালকের আসনে। ফাঁকা রাস্তায় ও এবার হাত মকশো করে নিচ্ছে। একটা নাছোরবান্দা মোরগ ছাড়া আর কোনো শব্দসূচক নেই গোটা দ্বীপে। হঠাৎ কারো দৌড়নোর আওয়াজ কানে এলো৷ পথের বাঁক ঘুরতেই দেখলাম একটি মেয়ে কালো গেঞ্জি আর ট্র্যাকপ্যান্ট পরে সকালবেলা দৌড়তে বেরিয়েছে... মাথায় কালো হেডব্যান্ড... পায়ে সাদা কালো স্নীকার্স। চাবুকের মতো শরীরে চুইয়ে পড়ছে প্রথম আলো। লাল সেলামের পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে আমাদের পানে চেয়ে একটু হাসলো। আমিও হাত নেড়ে হাসলাম...

    মোরগ ডাকছে... গাছের পাখিরা নতুন দিনের জন্য প্রস্তুত... কয়েকটা প্রজাপতি দিশেহারার মতো উড়ে বেড়াচ্ছে ইতস্তত... হঠাৎ মাটির দিকে তাকিয়ে দেখি একটা শামুক হেঁটে হেঁটে চলেছে। সাদা কালো ফুটকি দেওয়া গায়ের রং একেবারে পথের সঙ্গে মিশে রয়েছে।

    তখন জানতাম না যে আর কয়েক ঘণ্টা পরে ওর সাথে আবার দেখা হবে... সম্পূর্ণ অন্য পরিস্থিতিতে...

    শহরের ঠিক মাঝখানটিতে পান্ডেলি বেকারী। হলদে রঙের একতলা দোকানের গায়ে নরম সকালের রোদ। এ জায়গাটার কথা আগে জানতাম না। মামাসিটাস গেস্ট হাউসের ঠিক পাশের রাস্তাতেই দোকান। খানিক আগেই দোকান খুলেছে৷ একজন দুজন করে সবে খদ্দের আসতে শুরু করেছে। আমরা তাড়াতাড়ি লাল সেলামকে বেঁধে ছেদে কাচের দরজা খুলে দোকানে ঢুকলাম। টাইলস বসানো মেঝে... কাউন্টারে নানারকম মিষ্টিমাষ্টা সাজানো... ওপরে নোটিশ বোর্ডে মেনু লেখা আছে। ঊর্ধ্বমুখী হয়ে খাদ্যচাহিদা জানালে একজন অর্ডার লিখে নেবে আর অন্য একজন গরমাগরম রেঁধে দেবে৷ কয়েকটা টাইলস বসানো টেবিল আর প্লাস্টিকের চেয়ার সাজানো রয়েছে৷ আর রয়েছে কাগজের প্লেট আর স্টাইরোফোমের গেলাস।

    আমি আর জেনিফার পান্ডেলা বেকারীতে বসে পেট পুরে ডিম রুটি সসেজ ইত্যাদি নানা স্বাস্থ্যবর্ধক খাবার খেয়ে ক্ষান্ত দিলাম৷ আমি সঙ্গে নিলাম এক বোতল কমলা লেবুর রস৷ জেনিফার নিল মারাত্মক কড়া দু-কাপ তিতকুটে কফি। কারাওকের জ্বালায় প্রায় সারারাত জেগে ছিল বটে কিন্ত মনে হয় ঐরকম কফি খেলে আগামী দু-হপ্তাও জেগে থাকবে! আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে লাগল৷ আমরা লাল সেলামে চেপে শেষ বারের মতো মামাসিটাস গেস্ট হাউসে ফিরলাম।

    স্নান সেরে পোশাক পাল্টে নিলাম। নীলকমল থেকে এক্কেবারে লালকমল। সওয়ার হয়ে বেরোলে কোনটা যে গাড়ি আর কোনটা মানুষ বোঝা যাবে না। জেনিফার দেখলাম স্নান করে একই পোশাক পরে রইলো। বোঝাই যাচ্ছে যে আমার লাল ফুলতোলা কাপড়ের ব্যাগে ওর ব্যাকপ্যাকের ঢের বেশি জিনিস আঁটে।

    একতলার আপিস ঘরে টাকা মেটাতে গিয়ে রাত দুটো অব্দি কারাওকের আওয়াজ নিয়ে ঢিলেঢালার কাছে একটু গজর গজর করল জেনিফার...

    মোলায়েম মাখন হাসি হাসল ঢিলেঢালা...

    “হেঃ হেঃ... আপনাদের তো বলেছিলাম যে মামাসিটাস গেস্ট হাউসে উইকএন্ডে দারুণ সব নাচাগানার ব্যবস্থা থাকে... হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ...”  

    আমরাও হেঃ হেঃ করে বাইরের রোদ্দুরে।

    “জেনিফার একবার ফেরীঘাটে যাই চল৷ টিকিটের ব্যবস্থাটা বুঝে আসা যাক।”

    “তাই চল” 

    ফেরীঘাট ফাঁকা৷ কেউ কোত্থাও নেই।

    “কী ব্যাপার? এখন এখানে কী করছেন? এখন তো ফেরী নেই...” 

    চেয়ে দেখি বিয়ারের বোতল হাতে, ফুল ছাপ জামা আর হাফ প্যান্ট পরা এক লটর পটর আমেরিকান। ওঁর মনে হয় গতকাল রাত এখনো শেষ হয়নি... নইলে সকাল নটা নাগাদ কেউ মদ্যপান করে?

    “ না... মানে দুপুর একটার ফেরী ধরব... তাই টিকিট কাটতে এসেছিলাম...”

    “ ওহ... সে টিকিট তো এখন পাওয়া যাবে না... একটার ফেরীর টিকিট বিক্রি হবে বারোটা থেকে... তখন আসবেন... এখন এখানে কিসুই হবে না...”

    দেখলাম লটর পটর জাতে মাতাল তালে ঠিক। আর কথা না বাড়িয়ে লাল সেলামের মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে এগোলাম মেলোনেস বীচের পথে। খানিকটা পশ্চিমে গেলেই জনমানবশূন্য মেলোনেস বীচ। এইখানে সামুদ্রিক জীবজন্তুর অভয়াশ্রম। মাছ ধরা বা অন্য জীবজন্তুকে কোনোভাবে উত্যক্ত করা বিলকুল বারণ। কোথাও একটা আশ্চর্য পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল... শান্ত সমুদ্রে নরম ঢেউয়ের আওয়াজ... সব রকম নীল মিশিয়ে জল এঁকে রাখা হয়েছে যেন... আমি আর জেনিফার সেই বেলাভূমি ধরে হেঁটে গেলাম খানিকটা পথ... মাঝে মাঝে নীচু হয়ে কুড়িয়ে নিচ্ছিলাম নুড়ি, প্রবাল, ঝিনুক৷ কী প্রশান্তি সেই বেলাভূমিতে... সময় যেন থমকে রয়েছে... আর কোথাও যাবার নেই... কিছু পাবার নেই... কিছু হারাবার নেই...।

    “চল ২৫০ ধরে দ্বীপের পূব দিকটা দেখে আসি” জেনিফারের কথায় সম্বিত ফিরল...

    “চল”

    ২৫০ প্রথমে পুব দিকে যায় তারপরে হঠাৎ কী খেয়ালে উত্তরমুখো হয়ে এগোতে থাকে গেরস্থের বাড়ি, ভেড়ার খামার আর আস্তাবলের পাশ দিয়ে। একেবারে শেষ দিকটা রাস্তায় সাংঘাতিক উৎরাই আর রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে সমুদ্দুরে। টিলার ওপর থেকে ওই গা ছমছমে উতরাই দেখে মনে হচ্ছিল এবার বুঝি নড়বড়ে লাল সেলামকে নিয়ে হুরমুরিয়ে এক্কেবারে সাগরের গভীর নীলেই সলিল সমাধি! আমাদের আর দুপুর একটার ফেরী ধরতে হবে না!

    যাই হোক... কোনরকম অঘটন না ঘটিয়ে লাল সেলাম আমাদের জোনি বীচ ঘুরিয়ে আনলো৷ বেলাভূমির অসামান্য রূপ এতক্ষণে আমাদের কাছে জল ভাত হয়ে গ্যাছে। ডাকসাইটে রূপসী বিয়ে করা বউ হলে যা হয় আর কি... ঘর কা মুরগী ডাল বরাবর! তবু আরও একবার একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হতেই হল। ফেরার পথে চালকের আসনে জেনিফার। আমি তাই রাস্তার থেকে চোখ সরিয়ে আশ পাশটায় বেশি মনোযোগ দিতে পারছি... ঘন নীল জলের পাশ দিয়ে চলেছে লাল সেলাম।

    “জেনিফার একটু গাড়ি থামাও... গাড়ি থামাও... একটু ব্যাক কর... প্লিজ...”

    জেনিফারকে গাড়ি থামিয়ে হাতলটা বাঁদিকে ঘুরিয়ে খানিকটা পেছনপানে যেতে হল৷ গাড়ি থেকে নেমে জলের পাশটিতে গিয়ে ভাল করে ঠাহর করে আমরা দুজনে হতবাক৷ এইখানটা খানিক পাথুরে... জলে শিকড় ডুবিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে গরান গাছ... আর ঠিক তার পাশে... কী আশ্চর্য... কী আশ্চর্য... ঠিক তার পাশে... অনেক অনেক অনেকগুলি শঙ্খ...! তাদের গায়ে রোদের আলোয় এক গোলাপি আভা... কী স্নিগ্ধ রূপ... কেন যে তারা দল বেঁধে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে কে জানে... এরা কি সকলে মৃত?... এইখানেই কি তবে ইচ্ছামৃত্যু?... তাদের এমন আকস্মিক প্রকাশে আমরা মুগ্ধ।... ঠিক যখন মনে হচ্ছিল সবই তো জানা হয়ে গ্যাছে... দেখা হয়ে গ্যাছে... বোঝা হয়ে গ্যাছে... ঠিক তখন... ঠিক তখন... রাজকন্যা শঙ্খমালার সঙ্গে দেখা।

    “সাগর রানির সাগর কন্যা বুক পাতিয়া দিল
    হাজার শঙ্খে আরতি দিয়া পাতালপুরে নিল।”

    চলবে...

    ___________________

    *বাণিজ্যিক নৌ-শিক্ষণের সূত্রে সাতশোর উপর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সাগরে ভাসা ও নিত্য নতুন বন্দরে ভ্রমণ করেছেন আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস মেরিটাইম অ্যাকাডেমির অধ্যাপিকা মধুবাণী ঘোষ (Madhubani Ghosh)। অবিশ্বাস্য সেই ভ্রমণ কাহিনি ধারাবাহিকভাবে প্রতি সোমবার বেলা ১২টায় প্রকাশিত হচ্ছে বঙ্গদর্শনে। আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @