জব চার্নক, বেগম জনসনের স্মৃতি নিয়ে ২৩৩ বছরে সেন্ট জন’স গির্জা

কলকাতা শহরে ইউরোপের গন্ধ লেগে আছে নানারকম আয়োজনে, ব্যঞ্জনায়, বিন্যাসে। ইংরেজরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় নিয়েছে সে অনেক দশক হল। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষও এই শহর ছেড়ে চলে গেছেন বহুযুগ আগে। কিন্তু, কলকাতায় নিবিড়ভাবে বুনে দিয়ে গেছেন তাদের জীবনবৈচিত্র, সামাজিক যাপন, ভাবনার প্রাবল্য, হাসিকান্নার একাংশ। সেসবের হদিশ আমরা আজও পাই এই মায়ানগরীর রাস্তাঘাটের শিরা-উপশিরায় এবং স্থাপত্যে। সেন্ট জন'স গির্জা তেমনই এক স্থাপত্য, ইতিহাস-বিজড়িত।
অধুনা বিবাদি বাগের লাল দীঘির পাশেই সেন্ট জন'স গির্জা অবস্থিত। শহরের অন্যতম ব্যস্ত অঞ্চলে এক টুকরো সবুজ নিরালা নিয়ে, ইউরোপের নব্য-সনাতনী স্থাপত্যের নিদর্শন হয়ে গির্জাটি ১৭৮৭ সাল থেকে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন সেই সময়ের ভারতবর্ষের গভর্নর জেনেরাল ওয়ারেন হেস্টিংস স্বয়ং, ৬ এপ্রিল, ১৭৮৪-এ। চার্চের জন্য জমি দিয়েছিলেন শোভাবাজার রাজ-পরিবারের কুলপতি মহারাজা নবকিষান বাহাদুর। প্রসঙ্গত, ইতিহাসে এই গির্জাটির মূল গুরুত্ব ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতার প্রথম অ্যাংলিকান ক্যাথিড্রাল হিসেবে। ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরোধে সমন্বয়কারী মধ্যপন্থার কেন্দ্র হিসেবে উঠে এসেছিল অ্যাংলিকান ক্যাথিড্রালগুলি। পরে অবশ্য সেন্ট পলের এই গির্জা ক্যাথিড্রাল হিসেবেই বিবেচিত হতে শুরু করে। গির্জাটিকে এক সময়ে পাথুরে গির্জা বলা হত। কারণটা খুবই সহজ, গির্জাটি তৈরি করতে বিপুল পরিমাণ পাথর লেগেছিল। যে গৌড় অঞ্চলে (অধুনা মালদা জেলায়) পাল রাজাদের আধিপত্য ছিল, পরে তা সেনাবংশের সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়, যে গৌড় অঞ্চল বাংলার কেন্দ্র ছিল কম-বেশি তিনটে শতক, প্রথমে আফঘানদের পরে মুঘল শাসকদের অধীনে, আবহমান সময়ের অভূতপূর্ব কৌতুকে সেই গৌড়ের মধ্যযুগীয় ধ্বংসাবশেষ থেকেই প্রচুর পাথর একরকম লুঠ করে এনে গির্জাটি তৈরি করেছিলেন ইংরেজরা। প্রধান স্থাপত্যশিল্পী ছিলেন জেমস এ্যাগ। গির্জাটির মাঝেই রয়েছে এর একটা বিশেষ অংশের আশ্চর্য গড়ন। মাথা-সরু, লম্বাটে অনেকটা পিরামিডের মতো। উচ্চতায় ১৭৪ ফিট। এবং সেখানে যে বিশাল ঘড়িটি আছে, সেটায় আজ অবধি প্রত্যেকদিন নিয়ম করে দম দেওয়া হয়।
আপনি যখন গির্জার চত্বরে লাল মোরামের মসৃণ পথ আর গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটবেন, এক অদ্ভুত প্রশান্তি আপনাকে ঘিরে ধরবে। বাংলা আর প্রাচ্যের আশ্চর্য সামঞ্জস্য মুগ্ধ করবেই আপনাকে। মায়া-জড়ানো আবহে যদি সেন্ট জন'স গির্জার থামগুলো ঐরাবতের দাঁত সদৃশ্য মনে হয়, তাহলে অত্যুক্তি করা হয় না। গির্জাটিকে ঘিরে প্রহরীর মতন দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি নির্মাণ। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল এই শহরের তথাকথিত প্রতিষ্ঠাতা (তর্কসাপেক্ষ) জব চার্নকের স্মৃতিসৌধ। সাবেকি ঢঙে নির্মিত এই সৌধটিও অন্যান্য সৌধের মতন কতক গম্বুজাকৃতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিন্তু এর স্থাপত্য মৌলিক, কারণ এটির পৃষ্ঠতল আটকোণা, যেন চার্নকের বহুমুখী প্রশাসনিক দূরদর্শিতারই নিদর্শন। সৌধটি প্রতিষ্ঠা করেন চার্নকের জামাতা চার্লস এয়ের, ১৬৯৫ সালে, অর্থাৎ গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও প্রায় ৯২ বছর আগে।
গির্জা চত্বরে বিশেষত আর একজনের সমাধি অনেক সাহিত্যপ্রেমীদের কিছুটা হলেও চমৎকৃত করবে। নবারুণ ভট্টাচার্যের কাঙাল মালসাটের বেগম জনসনের কথা মনে পড়ে? উপন্যাসে মাঝে-মাঝেই আবির্ভাব হয়েছে তাঁর। সেই বেগম জনসন, অর্থাৎ লেডি ফ্রান্সিস জনসনের সমাধিটিও এই একই চত্বরে রয়েছে।
সেন্ট জন'স-এর সম্ভারে বেশ কয়েকটি অমূল্য পেইন্টিং আছে। প্রধান পেইন্টিংটির নাম 'লাস্ট সাপার' যা প্রবাদপ্রতিম মাইকেলাঞ্জলোর দা লাস্ট সাপারের অনুকরণে আঁকা। এঁকেছিলেন জার্মান শিল্পী ইয়োহান জোফান্নি। গ্রিক ধর্মযাজক ফাদার পার্থেনিওকে যিশু খ্রিস্টের আদলে আঁকা হয়েছে। মজার ব্যাপার হল, পেইন্টিং-এর অন্যান্য চরিত্ররা সেই যুগের ইস্ট ইন্ডিয়া ট্রেডিং কম্পানির স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ।
গির্জার মূল প্রার্থনা-কক্ষটিও সমান আকর্ষণীয়। জাফরি কাটা রঙিন টিন্টেড কাচের জানলা থেকে রোদের আলোখেলা একটা দেখার মতন জিনিস। ঘরের মেঝেটি অধুনালুপ্ত গৌড়ীয় ধূসর-নীল মার্বেলের তৈরি । দেওয়ালগুলোকে দর্শনীয় বানিয়েছে বিবিধ স্মৃতিফলক আর নানারকম মূর্তি।
কলকাতার ব্যস্ত অফিসপাড়ার হট্টগোল, গাড়ির আওয়াজ, পথচলতিদের ভিড়ের মাঝেই ইতিহাসকে জড়িয়ে অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ ও নিরালায় দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট জনের এই গির্জা। ২৩৩ বছর বয়স হল তার। অতীত এখানে এখনও কথা বলে পাথুরে দেওয়ালের গায়ে, স্থাপত্যে, গির্জার ছায়া ভরা চাতালে।
ছবিঃ সুমন সাধু