No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বেলঘরিয়ার হারিয়ে যাওয়া নদী

    বেলঘরিয়ার হারিয়ে যাওয়া নদী

    Story image

    কষ্টকল্পনা কিনা জানি না, কিন্তু নিমতার প্রাচীন লোকেদের ধারণা, বর্তমান বেলঘরিয়ার পূর্বদিকে নিমতার ওপর দিয়ে একসময় সোনাই নদী বয়ে যেত। কবে? এই প্রশ্নের কোনো নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি।

    প্রথমে আলোচনা করা যাক সোনাই নদী সম্পর্কে। বিভিন্ন রিপোর্ট ও বইপত্র থেকে সোনাই নদী সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যা বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন, কমল চৌধুরী তাঁর ‘চব্বিশ পরগণার ইতিহাস’ বইতে লিখেছেন – “যমুনার শাখা সোনাই চান্দুরিয়ার কাছে চব্বিশ পরগণায় ঢুকেছে। প্রথমে দক্ষিণ-পূর্বমুখী, তারপর দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে পড়েছে বল্লি বিলে। ইছামতীর যে জায়গা থেকে নদীটির উৎপত্তি, গত শতকের শেষে সেই স্থানে চড়া পড়ে যায়”। এখানে গত শতক বলতে উনিশ শতকের কথা বোঝানো হয়েছে। এই বইয়েরই আরেকটি অংশে লেখা আছে – “আমুদিয়া গ্রামের উত্তর দিয়ে গেছে সোনাই নদী। সোনাই নদী সোনাই খালের সঙ্গে ইছামতীর সঙ্গে যুক্ত। বল্লি বিলের মধ্য দিয়ে সোনাই খাল প্রবাহিত হয়ে স্বরূপনগরের দক্ষিণে মিশেছে ইছামতীর সঙ্গে।” কিন্তু এই নদী আমাদের অনুসন্ধানের সোনাই নদী নয়। একই নামের হলেও, এর উৎস বাংলাদেশ এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের পূর্বদিকের কিছুটা অংশে ভারত ও বাংলাদেশের সীমারেখা।

    জনসংহতি কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত ‘উত্তর চব্বিশ পরগণার নদনদী ও প্রাচীন সভ্যতা’ বইটি থেকে জানা যায়, “নোয়াই বা লাবণ্যবতী বরতি বিল থেকে বেরিয়ে খড়দহ, সুখচর, মধ্যমগ্রাম, রাজারহাটের পাশ দিয়ে হাড়োয়া গাঙে পড়েছে। ...এখন ক্ষীণকায়া সোনাই’কে স্থানীয় মানুষেরা নোয়াই বলে ডাকেন। ...সোনাই বা নোয়াইয়ের সোহাগী নাম তাই তাঁরা দিয়েছিলেন লাবণ্যবতী। ...ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে বৃহত্তর কলকাতার পূর্বপ্রান্তে যে অসংখ্য বিল ও বাঁওড় রয়েছে, সেগুলি মজে যাওয়া নোয়াই নদীর অবশিষ্টাংশ। ...নোয়াইয়ের মূল স্রোত সাঁইবনের পাশ দিয়ে দক্ষিণে বিদ্যাধরী পর্যন্ত প্রবাহিত ছিল। ...বড় জাগুলিয়া থেকে কাঁচড়াপাড়া হয়ে বেলঘরিয়া পর্যন্ত রেলপথের পূর্বাংশ এবং বিরাটি থেকে বড় জাগুলিয়া পর্যন্ত সমস্ত পশ্চিমাংশের জল নিকাশের পথ এই নোয়াই বা লাবণ্যবতী।” গুগল ম্যাপেও নোয়াই’এর এই গতিপথের সমর্থন মেলে। তাহলে নিমতার ওপর দিয়ে বয়ে গেল কীভাবে?

    এখানে আমাদের দ্বারস্থ হতে হবে ‘CALCUTTA METROPOLITAN WATER AND SANITATION AUTHORITY’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘SUSTAINING CALCUTTA’ বইটির। জানা যাচ্ছে, “Sonai which was a flowing “stream” almost a century ago, is now waiting to breathe her last as during decades she had none to look after and save her from human lust for land. In the absence of adequate constitutional safeguard together with the presently existing clumsey and weak law framework and consequent breakdown of traditional biophilia among people, a destructive property right developed gradually on Sonai turning her into a stretches of ponds with intermittent blockades of construction, brick-fiends, roads and playgrounds. ... Whether Sonai officially exists or not is a dubious question and reflect an overall apathy to environment and concerned matter on the part of those who raise it.” এবং, “The river Sonai originated from Koirapur of Ichapur, North 24 Parganas, which is connected with river Ganga. এই কৈরাপুরেই অবস্থিত বরতি বিল। গঙ্গার সঙ্গে বরতি বিলের সংযোগ সাধনকারী ইছাপুর খাল। এবং, “The river Sonai is a tributary of river Ganga”, অর্থাৎ সোনাই গঙ্গার উপনদী। এখানে বলা হয়েছে, সোনাই মিশেছে বাগজোলা খালে এবং বাগজোলা খাল সমাপ্তি লাভ করেছে হাড়োয়া গাঙে। হাড়োয়া গাঙ শেষ হচ্ছে বিদ্যাধরী নদীতে।

    এখন প্রশ্ন হল, বইটিতে টিটাগড়>খড়দহ>সোদপুর>নিমতা>দমদম>বাগজোলা খাল – সোনাই’এর এই গতিপথের উল্লেখ করা হয়েছে কেন? এই অঞ্চলের সঙ্গে যথেষ্ট দূরত্ব রেখেই মধ্যমগ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নোয়াই নদীটি, তাহলে? এর উত্তর একটাই হতে পারে, সোনাই ও নোয়াই এক নদী নয়। কিন্তু দুটিই বরতি বিল থেকে উৎপন্ন। নোয়াই এসেছে ‘লাবণ্যবতী’ নাম থেকে, এবং সোনাই ‘সুবর্ণবতী’ থেকে। উৎপত্তিস্থল এক হওয়ায় দুটি নদীর মধ্যে গুলিয়ে যেতেই পারে(যেটি উল্লিখিত আছে ‘উত্তর চব্বিশ পরগণার নদনদী ও প্রাচীন সভ্যতা’ বইয়ে), বিশেষত যখন নোয়াই নদী এখনও স্পষ্ট বর্তমান।

    সোনাই নদীটি এখন লুপ্ত। তবে, গতিপথে অবশিষ্ট জলাশয় দেখে অনুমান করা যায় নদীরেখাটি। ‘SUSTAINING CALCUTTA’ বইটিতে নথিবদ্ধ করা আছে টিটাগড় থেকে দমদম হয়ে বাগজোলা খাল পর্যন্ত জলাশয়ের সংখ্যা। সেই গতিপথে উত্তর নিমতায় ২টি ও দক্ষিণ নিমতায় ৮টি জলাশয়ই প্রমাণ করে যে, সোনাই নদী একসময় এই পথ দিয়ে বয়ে যেত।

    স্থানীয় অধিবাসী’রা কেন দাবি করে যে সোনাই নদী একসময় নিমতা দিয়ে বয়ে যেত? তাঁদের মতে, নিমতার মতো প্রাচীন একটি গ্রাম কোনো নদীর তীরে অবস্থিত না হলে এত সমৃদ্ধ হতে পারত না। নিমতায় এখনও ‘নদীকূল’ বলে একটি স্থান বর্তমান, যেটি বহন করছে সোনাই নদীর স্মৃতি। এছাড়া, বংশপরম্পরায় পূর্বজ’দের থেকে শুনে শুনে তাঁদের এই দাবি নিতান্ত উড়িয়ে দেয়া যায় না।

    আরেকটি প্রমাণ দেখলে চমকে উঠতে হয়। বর্তমানে যেখানে টেক্সম্যাকো কারখানা, সেখানে নীলকণ্ঠ চ্যাটার্জি’র ছেলে শ্রীশ চ্যাটার্জি উনবিংশ শতকে যখন ইঁটখোলার জন্য মাটি খনন করেন, বেরিয়ে আসে নোঙর, মোটা লোহার শিকল, ভাঙা মাস্তুল, মানুষের কঙ্কাল প্রভৃতি; যা স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয় একটি নৌকাডুবি’র। যদি এই অঞ্চলে কোনো নদী না-ই থাকত, তাহলে খননের পরে মাটির নিচ থেকে প্রাপ্ত জিনিসগুলির কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কি?

    এখনও পর্যন্ত কেউ জোর দিয়ে দাবি না করলেও, বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের পর, আমার মতে, বেলঘরিয়ার পূর্বদিকে নিমতা অঞ্চলের ওপর দিয়ে দিয়ে সোনাই নদী একসময় অবশ্যই বয়ে যেত এবং সমাপ্তি লাভ করত দমদমে বাগজোলা খালে। নদীটির লুপ্ত হওয়ার কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে আন্দাজ করা যায় জলস্রোতের অভাব। পরবর্তীকালে যত্রতত্র ময়লা ফেলা, বাসস্থান নির্মাণ প্রভৃতির কারণে হারিয়ে যায় নদীটির গতিপথও। তবে এখনও পানিহাটি পৌরসভা এলাকা, নাটাগড়, ঘোলা প্রভৃতি এলাকায় নদীটির অংশবিশেষ দেখতে পাওয়া যায়; কিছু কিছু জায়গায় জলাশয় এবং কোথাও বা একেবারেই চিহ্নহীন।

    সোনাই নদীর সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করলাম, কারণ আমায় ভাবিয়েছিল নিমতাবাসী’দের মুখে প্রচলিত কথাটি। আর, বেলঘরিয়া যেহেতু একসময় নিমতা’রই অন্তর্গত ছিল; এবং টেক্সম্যাকো অঞ্চল বেলঘরিয়াতেই পড়ে, কাজেই বর্তমান বেলঘরিয়ার সীমানার মধ্যে দিয়েও যে নদীটি বয়ে যেত একসময়, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। অদূর ভবিষ্যতে এই সূত্র ধরে কোনো নতুন তথ্য যে আবিষ্কৃত হবে না, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় কি?


    ঋণ – বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে
    লেখক – তন্ময় ভট্টাচার্য
    প্রকাশক – আরশিনগর প্রাণভূমি
    প্রকাশকাল - ২০১৬

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @