বিষ্ণুপুর ঘরানার কিংবদন্তিদের ভিটের খোঁজে

দেবদত্ত গুপ্ত ও পার্থ দাশগুপ্ত
সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ চলতে চলতে, আমরা পৌঁছোই এক সঙ্গীতগুণীর বসত ভিটেয়। তিনি হলেন গোঁসাই পাড়ার জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী। সেখানে গিয়ে আমাদের সাক্ষাৎ হল গোঁসাইজির প্রপৌত্র শ্রী জয়দেব গোস্বামীর সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমাদের মনে হল যে তিনি বলতে চান যে তাঁর দাদুর কথা আজ আর কেউ মনে রাখেনি। সামান্য দু চার কথা হয়তো হয়ে থাকে কালে ভদ্রে। কিন্তু আজ জ্ঞান গোঁসাইয়ের কথা বিষ্ণুপুরের আর কেউ মনে রাখেনি।
প্রায় একই ধরণের অভিজ্ঞতা হয় আমাদের ওস্তাদপাড়ায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির খোঁজ করতে গিয়ে। এইখানেই আমাদের চোখে পড়ে গোপেশ্বর বন্দ্যপাধ্যায়ের বসতভিটের খানিকটা অংশ এবং সেই সঙ্গে সঙ্গীতগুণী রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের ভিটের কালী মন্দির। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটের শীর্ষে লেখা রয়েছে সুরেন্দ্রনাথ ভবন। সেখানে বর্তমানে থাকেন নন্দন দত্ত। তাঁর মতে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ভিটেতেই শেষ জীবনে বসবাস করতেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা বিন্ধ্যবাসিনী দেবী। নন্দন দত্ত জানান শেষ বয়সে তাঁকে তিনি দেখভাল করতেন। এরকম গুণী একজন শিল্পী তাঁর জীবদ্দশায় কোনওরকম সম্মান পাননি। নন্দনবাবুর কথায় পরিষ্কার ভাবে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ হয়ে পড়ে। সেখানেই জানা যায় বর্তমানে গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাও অভাবের মধ্যে দিয়েই চলেছেন। তাঁর কন্যার নাম স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এখন নামমাত্র মাইনে পেয়ে রামশরণ সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
আরও পড়ুন
‘বিষ্ণুপুরী ঢং’ ও তার চরিত্র
আমাদের বিশেষ অন্বেষণ ছিল বিষ্ণুপুর ঘরের মহান সঙ্গীতগুণী তথা প্রাণপুরুষ তথা স্রষ্টা রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের বসতভিটে-র খোঁজ করা। প্রায় অনেকটা অনুসন্ধানের পর মল্লেশ্বর ভট্টাচার্য পাড়ায় আমরা সাক্ষাৎ পেলাম শ্রী ইন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের।
তাঁর সহায়তাতেই আমাদের সামনে এলো রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের লিখিত বিরাট পর্ব আর বন পর্বের পুথি। ইন্দ্রনাথবাবুর থেকেও জানা গেল রামশঙ্করের সময়কাল থেকে বিষ্ণুপুরে যে সঙ্গীত সম্মেলন হত সেটিই হল পূর্ব ভারতের প্রথম সঙ্গীত সম্মেলন। এই সম্মেলন আজও অব্যাহত। ইন্দ্রনাথ বাবুর মতে রামশঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁর সঙ্গীত চর্চার বিষয়ে ছিলেন গভীর ভাবে দার্শনিকের মতো। স্বয়ং যদুনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর ছাত্র। ইন্দ্রনাথবাবু দেখালেন তাঁদের বসত ভিটের দুর্গা দালান। সেই সঙ্গে সঙ্গীতের যে বিশেষ ধারার কথা ইন্দ্রনাথ বাবুর থেকে জানা গেল তা হল শাক্তভাব আর বৈষ্ণব ভাবের মিলনেই কিন্তু বিষ্ণুপুর ঘরানার নিজস্ব চরিত্র নির্ধারিত হয়েছে।
আরও জানালেন, রামশঙ্করের নিজের লিখিত সঙ্গীত ‘অজ্ঞান তম নিকরে’ গানটির একটি আলাদা দর্শন আছে। তা হল রামশঙ্করের যখন শেষ অবস্থা সেই শেষের দিনে তিনি তাঁর সমস্ত ছাত্রদের নির্দেশ দিয়েছিলেন গৃহ সংলগ্ন মন্দিরের সামনে তাঁকে নিয়ে যেতে এবং তাঁর লিখিত সেই গানটি শোনাতে। সেই সময় সকল ছাত্ররা মিলে সেই গান শুনিয়েছিলেন। ইন্দ্রনাথ বাবুর অনুরোধে সেই গানটি আমাদের পরিবেশন করে শোনান বিষ্ণুপুর ঘরের আরেকজন গায়ক বিষ্ণুপুরের বৈদ্য পাড়া নিবাসী শ্রী জগন্নাথ দাশগুপ্ত।