লকডাউন ফিরিয়ে দিয়েছে ‘স্মৃতির সাইকেল’

ক্রিং ক্রিং – চিঠি আছে। নব্বইয়ের দশক। সাধারণ মানুষের জীবনে মোবাইল, কম্পিউটার-মেইল, কিছুই নেই। আছে চিঠি। আছে সাইকেল (Bicycle)। ছোটোবেলায় পিয়ন কাকুকে দেখতাম নিরলসভাবে দুই চাকায় সওয়ার হয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন চিঠি। সাইকেল চড়েই পেপার কাকু, দুধওয়ালা কাকুরা আসতেন। আর বাবাকে দেখতাম কাকপক্ষী টের পাওয়ার আগে খুব ভোরের বাসে, মফস্সল থেকে শহরে যাচ্ছে চাকরি করতে। ভাবতাম পিয়ন কাকু, পেপার কাকু বা দুধওয়ালা কাকুর চাকরিটা কতই না সুখের; অফিসে ৮ ঘণ্টার বন্দিদশা নেই, বাসে-ট্রেনে চড়া নেই, যখন তখন ‘কাঁধে ঝোলা, চলল ভোলা’—সাইকেলে ঘুরে বেড়ানোর চাকরি। মনে মনে শপথ করেছিলাম বড়ো হয়ে এইরকম একটা ‘সাইকেল চালানো’র চাকরি নেবো। ‘আমতলা জামতলা/ ছুটি আজ পাঠশালা/ লুকোচুরি মেঘছায়া রোদ্দুর/ খাল বিল সরোবর নদী গাঙ/ সুবাতাসে জুঁই বেল/ বাজে বেল/ সাইকেল নিয়ে যাক বহূদূর।’ ইন্দ্রজিৎ সেনের কন্ঠে বাংলা গানের দল নগর ফিলোমেল-এর এই গানের মর্ম তাঁরা-ই বুঝবেন যাঁরা সাইকেলের মর্ম বোঝেন। সাইকেল নিয়ে বাঙালির রোম্যান্টিকতা একসময় এরকমই ছিল। শৈশব-কৈশোরে সাইকেল নিয়ে মজার স্মৃতি নেই, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
আমি বড়ো হলাম। নব্বই দশকের বয়স বেড়ে হল একুশের দশক। ‘সাইকেল চালানো’র চাকরিটা আমার আর করা হয়নি। সেটা আলাদা ব্যাপার কিন্তু মেট্রো-শহর তো বটেই, এমনকি গ্রাম-মফস্সলের দৈনন্দিন জীবন থেকে চোখে পড়ার মতো ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছিল সাইকেল। এতটাই যে বিগত কয়েক বছরে বেশি বেশি করে উঠে আসছিল সাইকেল সংক্রান্ত পরিবেশ অথবা স্বাস্থ্য সচেতনতার খবর।
অধুনা সাইকেল নিয়েই দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো রোমাঞ্চপ্রিয় বাঙালির সংখ্যা বেড়েছে। এমনকি সাইকেল নিয়ে ‘বিশ্ব জয়’ করে বেড়াচ্ছে বাঙালি তরুণরা, এমনই সব খবর উঠে এসেছে বিগত কয়েক বছরে। বছর পাঁচেক আগেই প্রথম বাঙালি হিসেবে ‘চাঁদের পাহাড়’ কিলিমাঞ্জারোর চুড়োয় উঠেছিলেন উজ্জ্বল পাল। নিছক খেয়ালের বশে ভূপর্যটক হিসেবে নয়, উজ্জ্বল পালের এহেন সাইকেলযাত্রার আড়ালে থাকে সবুজের বার্তা। উজ্জ্বল তার নাম দিয়েছিলেন ‘গ্রিন অন হুইল’।
লকডাউনে দেখা গেল হু হু করে বেড়ে গেল বিভিন্নরকম সাইকেল কেনার চাহিদা। সাইকেলে দূষণ নেই, এনার্জি ছাড়া তেমন কোনও খরচের হ্যাপাও নেই। জরুরি দরকারে, শরীর চর্চায় অথবা ফুরফুরে হাওয়ায় মন চাঙ্গা করতে লকডাউনে যেন ধড়ে প্রান ফিরে পেল সাইকেল।
২০১৯-এ সাইকেলে চড়ে সারা বাংলা ঘুরে প্লাস্টিক বর্জনের বার্তা দিয়েছিলেন পূর্ব বর্ধমানের মেমারির অর্ক পাল। ঐ বছরই, অক্টোবরে “গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান” – এই বার্তাকে সামনে রেখে সাইকেলে কলকাতা থেকে ডুয়ার্স যাত্রা করেছিলেন ৮ জনের একটি দল। গোটা যাত্রাপথে ৩৫০টি চারাগাছ রোপণ করে তাঁরা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন। চলতে চলতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাঁদের পরিবেশ-সচেতন করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন তাঁরা। এরকম আরও আরও উদাহরণ আছে।
২০২০ সাল। করোনা, লকডাউনের বছর। লকডাউনে দেখা গেল হু হু করে বেড়ে গেল বিভিন্নরকম সাইকেল কেনার চাহিদা। সাইকেলে দূষণ নেই, এনার্জি ছাড়া তেমন কোনও খরচের হ্যাপাও নেই। জরুরি দরকারে, শরীর চর্চায় অথবা ফুরফুরে হাওয়ায় মন চাঙ্গা করতে লকডাউনে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল সাইকেল।
এই এক বছরে মফস্সলের কতশত সাধারণ মানুষ জীবিকার জন্য শহরে আসতে বেছে নিয়েছেন সাইকেল। কেউ অসুস্থ ছেলের অসুধ আনতে সাইকেল নিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন হায়দ্রাবাদে, কেউ সারিয়ে দিয়েছেন মেয়ের পুরোনো সাইকেল, কেউ আবার লকডাউনে অন্য রাজ্য থেকে নিজের গ্রামে ফিরতে পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন সাইকেল, এরকম হাজারো খবর উঠে এসেছে এই এক বছরে। ২০০৮ সালে কলকাতার কিছু রাস্তায় সাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেয় তখনকার সরকার। তখনই প্রতিবাদ করেছিলেন কিছু সাইকেলপ্রেমী। ২০০৯ সালে রঘু জানা সহ বেশ কয়েকজন প্রশাসনের দ্বারস্থ হন। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি। এরপরই শহরের সাইকেলপ্রেমীরা নিজেদের সংগঠন তৈরি করেন। রাজ্য সরকারের কাছে রঘু জানার আর্জি ছিল, ‘কলকাতার রাস্তাতেও সাইকেলের আলাদা রাস্তা থাকুক। দুর্ঘটনা ও দূষণ, দুইই কম হবে এতে।’ ২০২০ সালে বর্তমান সরকারের তরফে বিশ্বের অনেক আধুনিক শহরের মতো কলকাতার রাস্তায় হয়েছে সাইকেলের আলাদা লেন। সেই বছরের সেপ্টেম্বরেই কলকাতার স্মার্ট সিটি নিউ টাউনে শুরু হয়েছিল অ্যাপ-নির্ভর সবুজ সাইকেল পরিষেবা। উদ্বোধন করেছিলেন পরিবহন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
সাইকেল কতটা উপকারী তা অনেকেই টের পেয়েছেন লকডাউনের সময়। লকডাউন ফিরিয়ে দিয়েছে স্মৃতির সাইকেল। আজ ৩ জুন, বিশ্ব বাই-সাইকেল দিবস (World Bicycle Day)। ২০১৮ সাল থেকে এই দিনেই রাষ্ট্রসংঘ প্রথম ‘বাই-সাইকেল দিবস’ পালন শুরু করে। পরিশেষে ইতালিয়ান ইতিহাসবিদ উমবার্তো ইকোর এই কথাটা বলি, যতই ই-বুক আসুক, বই থাকবে, যেমন যতই মোটরগাড়ি–মোটরসাইকেল আসুক, পায়ে ঠেলা সাইকেল থাকবেই। আর বলি আইনস্টাইনের কথা, জীবন হল বাইসাইকেল চালানোর মতো, সব সময় চালাতে হয়, তা নাহলে পড়ে যেতে হয়!
তথ্যসূত্রঃ
বঙ্গদর্শন আর্কাইভ