“আমার এক বন্ধু বাড়িতে জানাতে পারেনি সে সমকামী, জোর করে তার বিয়ে দেওয়া হয়”

তথাগত ঘোষ। ছাত্রাবস্থায় ছবি নির্মাণ করেছেন টুকটাক। তার অনেক বছর পর ‘দৈত্য’ ছোটো ছবির মাধ্যমে তাঁর কাজ পৌঁছে গেছে দেশে-বিদেশে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তথাগতর দ্বিতীয় ছবির ট্রেলার। ‘মিস ম্যান’। ‘মিস ম্যান’ ছবির গল্প তিনি তাঁর জীবন এবং চারপাশের কিছু ভাবনা থেকেই পেয়েছেন। মানব, যে প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ছেলে। তার বড়ো হয়ে ওঠা এক প্রাচীন রক্ষণশীল সমাজে। মানবের বাবা হোমোফোবিক। স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে যখন মানব শাড়ি পরে নেচে প্রথম হয়েছিল, তখন তাঁর বাবা খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু একটু বড়ো হবার পর যখন নিজের সত্ত্বা বাবাকে বলতে গেল, বাবার পক্ষে তা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। মানবের জীবনে প্রেম আসে। প্রথম প্রেমের মতোই সজীব, তরতাজা একটি প্রেম। কিন্তু এখানেও সমস্যা। মানবের প্রেমিক প্রেম হিসাবে পেতে চায় একজন মহিলাকেই, কিন্তু একটা দমকা হাওয়ায় মানবের প্রেমে পড়ে। ছেলেটি প্রশ্ন তোলে। ছেলেটি মানবকে পেতে চায় একজন নারী হিসাবেই…
ছবির একটি দৃশ্যে অর্ঘ্য অধিকারী (মানব)
মানব লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য চলে আসে কলকাতা। এই তিলোত্তমায় ডুবে যেতে থাকে মানব। আকৃষ্ট হয় একজন মহিলার প্রতি। শুরু করে নিজের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে সোচ্চার হতে। মানব কি একজন মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে পুরুষ হিসাবে? নাকি নারী হিসাবে? তাঁর স্বাধীন লিঙ্গ রাজনীতি কোন প্রশ্নের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে? সে কি সমকামী না উভকামী? এই যাবতীয় প্রশ্ন দড়ির মতো ঝুলে আছে মানবের মনে, দেহে, ভালোবাসায়।
শুটিং-এর মুহূর্ত
আরও পড়ুন
“আমার লড়াইটা কিছু কমেনি, বরং আরও বেড়েছে”
পরিচালক তথাগত ঘোষ জানাচ্ছেন, “আমার এক কাছের বন্ধু বাড়িতে জানাতে পারেনি যে সে সমকামী। জোর করে তার বিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। কষ্ট দিয়েছিল। তখনই মনে হয়েছিল একটা সিনেমা বানাব। সেখান থেকেই জন্ম হল মিস ম্যান-এর।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় হয়েছে ‘মিস ম্যান’ ছবির ট্রেলার। এই সমকাম-বিদ্বেষী সমাজে দাঁড়িয়ে, যখন ৩৭৭ বিল পাস হয়ে গিয়ে বছরও কেটে যায়, ঠিক সেইসময় তথাগতরা প্রশ্ন তুলছেন – ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা? এই ছবির প্রত্যেকটি ফ্রেম পরতে পরতে জন্ম দেবে একটি ছেলের কিছু না বলা আর তুমুল সোচ্চার হওয়ার কাহিনি, গ্রাম থেকে শহরে এসে নিজেকে আবিষ্কার করার কাহিনি, প্রতিদিন নিজের পথ চওড়া হওয়া আর লিঙ্গ রাজনীতির সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত প্রশ্ন তোলার কাহিনি।
ছবির একটি দৃশ্যে রাত্রিশ সাহা
ঋতুপর্ণ ঘোষ ২০১২ সালে তাঁর ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবিতে দেখিয়েছিলেন, মহাভারতে অর্জুন যেমন চিত্রাঙ্গদাকে আন্দোলিত করেছিল, এই ছবিতে তেমনি পার্থ করেছে রুদ্রকে। পার্থর প্রতি রুদ্রর আকর্ষণের উচ্চারণ অমোঘ। কিন্তু রুদ্র যখনই লিঙ্গ পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়, পার্থ তাঁর জীবন থেকে সরে যেতে থাকে একটু একটু করে। অন্যদিকে ২০১৯ সালে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নগরকীর্তন’ ছবিতে পুঁটি তার মধুদাকে বলেছিল, “আমার শরীরে ভুল রয়েছে মধু দা... ঠিক করতে হবে”। আসল নকলের টানাপোড়েনের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক খাঁচায় আটকে থাকা এক ‘নারী’ ও একটি ‘পুরুষ’-এর ভালোবাসার গল্প এবং ক্রাইসিসের গল্প বলেছিল এই ছবি। আসলে আমাদের সমাজের এবং মনের ক্রাইসিসগুলো খুব কম বাংলা ছবিতেই উঠে এসেছে। ‘শরীর’ আসলে শুধুমাত্র শরীরী নয়, শরীরের মধ্যেও যে একটা মন আছে, সেই প্রশ্নই এবার তুলতে চাইছেন তরুণ পরিচালক তথাগত ঘোষ তাঁর ‘মিস ম্যান’ ছবির মাধ্যমে। যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই ছবির নাম, সেভাবেই ‘মানব’ নামক চরিত্রটির নামও আমাদের ভাবায়। মানবদের কথা কি সবাই শুনবে?
পরিচালক তথাগত ঘোষ
কলকাতাবাসীর কাছে তাই এবার দারুণ খবর। আগামী ১ ডিসেম্বর, রোববার, সকাল ১০-৩০টায়, বসুশ্রী সিনেমাহলে কলকাতা আন্তর্জাতিক এলজিবিটিকিউ+ চলচ্চিত্র ও ভিডিও উৎসবের ‘ডায়ালগ্স’-এ দেখানো হতে চলেছে এই ছবি। এর আগে ব্যাঙ্গালোর কুয়্যার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, সাউথ এশিয়ান কুয়্যার শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, পন্ডিচেরি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, মাদ্রিদ ইন্টারন্যশনাল এলজিবিটিআই ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, সাংহাই কুয়্যায় ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ইত্যাদিতে প্রশংসিত হয়েছে ‘মিস ম্যান’। ছবিতে অভিনয় করেছেন অর্ঘ্য অধিকারী, রাত্রিশ সাহা প্রমুখ।