বৈদ্যবাটির বক্সীবাড়ি হয়ে উঠুক বাঙালির তীর্থক্ষেত্র

গত ১৫ নভেম্বর, ২০২১ ছিল ভারতীয় শব-ব্যবচ্ছেদের পুরোধা মধুসূদন গুপ্তের মৃত্যুর ১৬৫তম বছর। চির উদাসীন বাঙালির হয়তো মনেও নেই সে কথা। হুগলির বৈদ্যবাটির স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংবাদিক তপেশ বসু বলছিলেন ১৫ বছর আগের অভিজ্ঞতার কথা। বৈদ্যবাটিতে তপেশদা মধুসূদন গুপ্তের বাড়ির কিছুটা সামনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘মধুসূদন গুপ্তের বাড়িটা ঠিক কোনদিকে?’
খানিক চিন্তা করে বেশ গম্ভীর স্বরে কলেজপড়ুয়া একদল ছেলে বলেছিল,
- ‘মধুদাকে বাড়িতে এখন পাবেন না। মেডিকেল স্টোর বন্ধ করে বাড়ি চলে গেছেন।’
সেদিন হতাশ হয়েছিলেন তপেশদা। তপেশদার মতে, “আজও ছবিটা পাল্টায়নি। কেউ মনে রাখেনি যে, মধুসূদন গুপ্ত প্রথম বাঙালি শল্যবিদ, যিনি চিকিৎসক হয়ে শব ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন। পাশাপাশি নিজের দেহদানের অঙ্গীকার তিনিই প্রথম করেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিপক্ষে গিয়ে যদি তিনি এই পদক্ষেপ না নিতেন তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটা দিক অন্ধকারে ঢাকা থাকত।”
বৈদ্যবাটির বক্সীবাড়ির সন্ধান আজকের গুগল সার্চ ইঞ্জিন কতটা জানে? বক্সীবাড়িতে ঢুকলে কজনই বা জানবেন গুপ্তদের বাড়ির নাম হঠাৎ বক্সীবাড়ি কেন? অথচ বক্সীবাড়ির সাড়ে তিনশো বছরের দুর্গাপুজো দেখতে কত ভিড় হয়!
আমি আর কারও ভরসা না করেই বক্সীবাড়ি রওনা দিলাম। বৈদ্যবাটি স্টেশন থেকে হাঁটলে আধঘণ্টার বেশি। বক্সীবাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম, যে সম্ভ্রান্ত বৈদ্য বংশে মধুসূদন গুপ্ত জন্মেছিলেন, তাঁদের পারিবারিক পেশার দরুণ শাসক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ছিল খুব ঘনিষ্ঠতা। অনুমান করা যায় তাঁরা উত্তরবঙ্গ থেকে মুর্শিদাবাদে আসেন। মধুসূদন গুপ্তের পিতার ঠাকুরদা কালীচরণ গুপ্ত তৎকালীন মুর্শিদাবাদের নবাবের থেকেই ‘বক্সী’ উপাধি অর্জন করেছিলেন। তিনি নবাবের আর্থিক বিষয়ের দায়দায়িত্ব পালন করতেন বলে তাঁকে ‘বক্সী’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। মধুসূদনের পৈতৃক ভিটে বক্সীবাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাঁর পুত্র গোপালশরণ। মুর্শিদাবাদে নবাবি শাসনের অবসান হলে তিনি বৈদ্যবাটিতে চলে আসেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে শিক্ষালাভ করে হুগলির নবাবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হন তিনি। বোঝাই যাচ্ছে এঁদের পারিবারিক পেশাই ছিল চিকিৎসা। কাজেই গোপালশরণের পৌত্র মধুসূদন গুপ্ত যে চিকিৎসাবিদ্যায় মেধার স্বাক্ষর রাখবেনই, সেটাই স্বাভাবিক!
সে যুগে স্বাস্থ্যের জন্য মানুষের নির্ভরতা ছিল হেকিমি আর কবিরাজী বিদ্যের ওপর। আর মেডিকেল বা ডাক্তারি চিকিৎসার উদ্ভব হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগে। তবে মেডিকেল পাঠক্রমে তখনও শব-ব্যবচ্ছেদের ধারণা চালু ছিল না। এমনিতে সনাতনী হিন্দু সমাজে চিরকাল অচ্ছুৎ নিচু শ্রেণির মানুষরাই শব ছোঁয়ার অধিকার পেয়েছে। সাগর পেরোনোর মতো শব ছুঁলে যে উচ্চশ্রেণির হিন্দুর জাত যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না। কাজেই মেডিকেলের ক্ষেত্রেও বই এবং শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করেই চলত মানুষের শরীরের গলি-ঘুঁজিতে রোগের স্বরূপ নির্ণয়ের কাজ। এ রকম অবস্থাতেই দ্বারকানাথ ঠাকুর ও মুর্শিদাবাদের নবাবের মতো কয়েকজন মানুষের ঐকান্তিক উৎসাহে মেডিকেল কলেজের শিক্ষক গুডিভ সাহেব ঠিক করলেন পাঠ্যসূচিতে শব-ব্যবচ্ছেদ অন্তর্ভুক্তি করবেন। কিন্তু সনাতনী হিন্দু কুসংস্কার কাটিয়ে কে এগিয়ে আসবে? বৈদ্যবাটির ভূমিপুত্র হয়ে প্রবল মানসিক চাপ কি মধুসূদন অনুভব করেননি? অবশ্যই ধর্ম অধর্ম নিয়ে দ্বিধা ছিল তাঁরও মনে। তাই শব ব্যবচ্ছেদের সেই ঐতিহাসিক দিনে তিনি লক্ষ্য স্থির করতে সময় নিয়েছিলেন খানিকটা। হয়তো মেডিকেল কলেজে তাপস মধুসূদন আরও বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রের দিকে এগোনের লক্ষ্যে শপথ নিচ্ছিলেন সেদিন মনে মনে।
দিনটা ছিল ১৮৩৬ সালের ১০ জানুয়ারি। সতীদাহ রদের পর আবার বাঙালির কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জয় হল। মধুসূদনের শব ব্যবচ্ছেদের পর পরই ফোর্ট উইলিয়ম থেকে তোপ ধ্বনি করা হল। এরপর ২৮ অক্টোবর ইংরেজ ডাক্তার গুডিভের তত্বাবধানে মধুসূদন গুপ্ত চারজন সেরা ছাত্রকে নিয়ে শব ব্যবচ্ছেদ করেন। এই চারজন ছাত্রই আমাদের দেশের প্রথম অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার— উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত এবং নবীনচন্দ্র মিত্র। শুরু হল মেডিকেল কলেজের জয়যাত্রা।
তিনি বিধিবদ্ধ ডাক্তার নন। অথচ ডাক্তারদের শিক্ষাগুরু। সেই সংস্কৃত কলেজ থেকে তার অধ্যাপক পদ প্রাপ্তি নিয়ে পেছনকার শোরগোল তখনও থামেনি কিন্তু। তাই ১৮৪০ সালে অধ্যাপক মধুসূদনকে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেবার জন্য ছাত্রদের সঙ্গে ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। এতে সফল হয়ে তিনি হলেন ডাক্তার। তা’বলে তাঁর জার্নি এখানেই শেষ নয়। কারণ, তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও বটে। গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা করার পাশাপাশি তিনি টিকা নিয়ে মানুষের কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও লড়েছেন। তিনি সে শতকেই কলকাতায় রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য পানীয় জল, পয়ঃপ্রণালী, রাস্তা ও নর্দমাকে দায়ী করেছিলেন এবং মহিলাদের প্রসবের জন্য উপযুক্ত আঁতুড়ঘর নির্মাণের দিকে আঙুল তুলেছিলেন।
পরের স্বাস্থ্যের চিন্তায় তিনি নিজেকে এমনভাবে নিয়োগ করেছিলেন যে নিজের কথা তাঁর মনেই পড়ত না। ১৮৫৬ সালে শব ব্যবচ্ছেদের এই জনকের মৃত্যুও হয়েছিল শব ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে। মৃতদেহ থেকে সংক্রামিত হয়ে ডায়াবেটিক গ্যাংগ্রিনে তাঁর মৃত্যুও যেন তাঁর সেই কর্মধারায় মিশে অমর হয়ে যায়।
প্রশাসনিক নথিতে লেখা হয়েছিল,
“আশাকরি দেশবাসী তাঁর উদাহরণ উপলব্ধি করে, কুসংস্কারের বিজয়কে স্মরণ করে রাখবার জন্য তাঁর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করবেন।”
আক্ষেপ নেই আমাদের। চেতনা নেই বৈদ্যবাটির। তৎকালীন কলেজ হলের প্রবেশদ্বারে একটি মার্বেল ফলক ছাড়া তেমন কোনও স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়নি। পুরোনো সেই বাড়ি ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সেটুকুও শেষ! খুঁজলে একটা তৈলচিত্র পাওয়া যাবে এখনকার মেডিকেল কলেজে।
বৈদ্যবাটি থেকে ফেরার সময় দেখলাম, নিয়ন আলোয় ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে রাস্তার হোর্ডিং আর গ্লোসাইন বোর্ডগুলো। মনে হল, দেহদান করার বিষয়টি মিডিয়ার নজরে এসেছে। শুধু কোনও ক্ষেত্রেই উঠে আসেনি বাঙালির ভুলে যাওয়া একটি নাম— পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত। ১৮৩৬ সালের ১০ জানুয়ারি তিনিই শব ব্যবচ্ছেদ শুরু করেন। সেইদিন ফোর্ট উইলিয়ম থেকে ২১বার তোপ ধ্বনি করা হয়েছিল। ২০২২-এ তার ১৮৬ বছর হল।