কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জোরাজুরিতে রেডিওয় প্রথম অডিশন দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। জানলায় মাথা রেখে একলা হতে চাইছে বর্ষাপ্রিয় বাঙালি। হঠাৎই অজান্তে গুনগুনিয়ে উঠল মেঘলা দিনের সুর, '....কাছে যাব কবে পাব, ওগো তোমার নিমন্ত্রণ'। মধুকণ্ঠে একা থেকে দোকা হওয়া সে ঘর জুড়ে তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (Hemanta Mukhopadhyay)। আবার দীর্ঘ অদর্শন অপেক্ষার পালা শেষে যখন প্রিয় আনন্দে ঘর ভরে ওঠে তখনও হেমন্ত গেয়ে ওঠেন 'তুমি এলে, অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এল.. '। সেই কাঙ্খিত বৃষ্টির সুরে তখন সুর না মিলিয়ে আর উপায় কি আমবাঙালির! বারবার কেবল বাঙালি অনুসঙ্গেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে জুড়ে দিতে চাওয়ায় বাঙালির এক গর্বিত শ্লাঘা আছে নিশ্চয়ই, তবু প্রাচীন অর্বাচীন সংগীতপ্রেমী অর্থেই জানেন ভারতবর্ষের সুরের আকাশে আজও নিশ্চিত ধ্রুবতারা এই মানুষটিই। 'মেলোডি কুইন'-এর পুরুষ পরিভাষা যদি 'মেলোডি কিং' হয়, তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আক্ষরিক অর্থেই সেই সুরের রাজা। আজ সেই সুরের রাজার একশো পূর্ণ হওয়া পুণ্য জন্মদিন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর গানের ভুবন হেমন্ত ভরিয়ে রেখেছিলেন বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, অহমিয়ার মতো বিবিধ ভাষার গানে।
অথচ, শুরুটা এমন ছিল না, সে অর্থে গানের প্রথাগত তালিম বলতে বোঝায় তা নেওয়া হয়নি তাঁর। ভালো লাগত তাই শুনে শুনেই গলায় তুলে নিতেন যেকোনো গান। যখন ক্লাস নাইনে পড়ছেন তখন বন্ধু (কবি) সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জোরাজুরিতে রেডিওয় অডিশন দিয়েছিলেন হেমন্ত। ১৯৩৫ সাল তখন, পরপর দুবছর তিনি এসময় রেডিওতে গান গেয়েছিলেন। এরপর স্কুলের পড়া চুকিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করলেন তখনও ভাবেননি গানই তাঁর জীবনজুড়ে বসবে। সরকারি চাকরির সুবিধের জন্য তাই শর্টহ্যান্ড টাইপ শিখতেও শুরু করলেন এসময়ে। এসবের মধ্যেই আবার সেই বন্ধু সুভাষের আগ্রহেই বিভিন্ন জায়গায় তাঁর যাওয়া রেকর্ডিং-এর জন্য।
“এই মেঘলা দিনে একলা”
ভাবতে আশ্চর্য লাগে গোধূলির রঙে এ পৃথিবীকে মায়াময় হতে দেখার মুগ্ধতায় যে বাঙালি পরবর্তীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে 'বেশ তো' বলবে, তাদের কাছে প্রথম যুগে কোনো সুযোগই পাননি হেমন্ত। অনেক ঘোরাঘুরির পর ১৯৩৭-এ শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে হেমন্তর কলম্বিয়া লেবেলে প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডেড গান 'জানিতে যদি গো তুমি, পাষাণে কী ব্যথা আছে' বাজারে আসে। পরবর্তীতে হেমন্ত নিজেই বলছেন বহুকাল আগের নিজের সে গায়কি শুনলে নিজেরই নাকি হাসি পায়। তাঁর প্রথম সিনেমার গান 'নিমাই সন্ন্যাস' ছবিতে। এসবের মাঝেই হেমন্ত চল্লিশের দশকেই নিজের সুরে প্রথম গাইলেন 'কথা কয়ো নাকো, শুধু শোনো'। কী অদ্ভুত না! সত্যিই যেন তারপর থেকে আমরা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে নিজেদের কথা, স্বর সব হারিয়ে কেবল শুনেই গেলাম। উত্তমকুমারের অসাধারণ লিপে মহানায়কের নিজের কণ্ঠস্বরও হেমন্তময় হয়েছিল বুঝি!
তাই 'সপ্তপদী'-র রীনা ব্রাউনের সঙ্গে উত্তমকুমার নন, 'এই পথ যদি না শেষ হয়' সর্বার্থেই গেয়েছেন হেমন্ত।ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট হলে জীবনের প্রথম পাবলিক ফাংশনে গান গাওয়ার সুযোগ পাননি, কারণ সে সময়ের আইকন পঙ্কজ মল্লিক হেমন্তর ডাক আসার আগেই এসে পড়েছিলেন গাইতে, তাই মনপ্রাণ ভরে কাছ থেকে পঙ্কজবাবুকে শোনার আনন্দ নিয়েই বাড়ি ফিরেছিলেন সেদিন তিনি। তারপর এই মানুষটিরই প্রভাব পড়ল হেমন্তের গানে, নিজেই বলেছেন সে কথা। রেকর্ড করার আগে পর্যন্ত হেমন্ত জানতেনই না রবিগানের স্বরলিপির কথা, তারপর শৈলেশ দত্ত গুপ্তের কাছে জানতে পেরে স্বরলিপি দেখে গান তুলে জীবনে প্রথম রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেছিলেন ১৯৪৪ সালে। সেই প্রথম বড়োবাড়ির বইয়ের আলমারি পেরিয়ে মধ্যবিত্তের জলসায় স্থান পেয়েছিল 'গীতবিতান'। আইপিটিএ-র জন্য বাঁধা সলিল চৌধুরীর জাগরণের গান প্রাণ পেয়েছে তাঁর কণ্ঠে। সময়ের অস্বস্তি, হতভাগ্যের চিহ্ন কিংবা মানুষকে চেনার গান হিসেবে আজও কানে বাজে 'গাঁয়ের বধূ ', 'রানার', 'পাল্কির গান'।
“এই রাত তোমার আমার”
রাজনৈতিক অস্থিরতায় দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের গান হয়ে উঠেছে হেমন্তের কণ্ঠে কবি সুকান্তের লেখা 'অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি, জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি...'। ফৈয়াস হাসমির লেখায় কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রথম হিন্দি গান গেয়ে হেমন্ত হয়ে উঠেছিলেন হেমন্তকুমার। হিন্দি 'আনন্দমঠ', 'আনারকলি', 'নাগিন'-এর মত অজস্র হিট সুরে মাতিয়ে রেখেছেন এই পর্বেই। একই সঙ্গে চলেছে অজস্র বাংলা ছবিতে সংগীত পরিচালনা, প্রযোজনা, সুরারোপ ও গান গাওয়ার কাজ। 'নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর পরে' ওই নীলাকাশ'-এর নীলিমা দেখার সুযোগ বাঙালি পেয়েছিল সাদা ধুতি শার্টের এই মানুষটার জন্যই। বালুকাবেলায় একটি সে নাম লেখার শখও সে লালন করেছিল এই মানুষটাকে শুনেই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্যই বাংলা গানে আমরা পেয়েছি কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকরকে, হেমন্তর কথা মতো রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ডের মধ্যে দিয়েই লতাজীর প্রথম বাংলা গান গাইতে আসা। আজও যখন পূর্ণিমার আলোয় ঘর ভেসে যায়, আধুনিক রোমান্টিক বাঙালি সোশ্যাল মিডিয়ার স্টেটাস হিসেবে সবচেয়ে বেশি হাতড়ায় রবীন্দ্রনাথকে আর নয়ত লিখে ফেলে 'এই রাত তোমার আমার... '। 'পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে' ছুটে যেতে আজও ডাক দেন হেমন্তই। বাঙালিকে বাংলা উচ্চারণ শিখিয়েছেন তিনি, নিষ্ঠাভরে গান শুনতেও শিখিয়েছেন, বিপদে আপদে শুধু নয় মানুষের পাশে থাকার জন্যই পাশে থাকতে শিখিয়েছেন। মিঠে পাকে প্রশ্ন করিয়েছেন অলির কথা শুনে যেমন বকুল হাসে তেমন করে আমরা হেসে উঠি না কেন! প্রশ্রয় দেওয়া প্রেমিকের মতো বারণ করেছেন, 'তারে বলে দিও, সে যেন আসে না আমার দ্বারে..।' নীল ধ্রুবতারারও কিছু প্রশ্ন আছে আমাদের কাছে, হেমন্ত না বলে দিলে আমরা বুঝতাম বুঝি!
ওস্তাদ আমির খাঁ সাহেব খুব পছন্দ করতেন তাঁর গান, এতে খুব উৎসাহ পেয়েছিলেন হেমন্ত। প্রবলভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষটি মনে করতেন তাঁর গলা তাঁর নিজের নয়, ঈশ্বরেরই করুণার দান, তাই নিজের ইচ্ছেয় নয় বরং যতদিন সেই পরম করুণাময় গাওয়াবেন, ততদিনই তিনি গেয়ে যাবেন। প্রকৃত শিল্পীরা বোধহয় এইরকমই হন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ছুঁয়ে ওয়েষ্টইন্ডিজের মানুষের মনে হয়েছিল তারা ভারতবর্ষকে ছুঁতে পারল যেন। ভারতের সুরকে বহন করা এই মানুষটি গেয়েছিলেন 'আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে... আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোনো'। আমরা নিজের নিজের বোধে সে কান পেতে রয়েছি, থাকবও জীবনভর। কারণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গান গাইলে আজও বৃষ্টি পড়ে, ঝড় ওঠে, বাউল বাতাস বয় আর হালফিলের কোনো আধুনিক হৃদয়ও ডুবে যায় প্রেমে।
তথ্যসূত্র : দূরদর্শন আর্কাইভ