টুনি বাল্ব, এলইডির মধ্যেও মাটির প্রদীপের নস্টালজিয়াকে টক্কর দিতে পারেনি কেউ

কালীপুজো মানেই আলোর উৎসবে মেতে উঠবে ভারতের মানচিত্র। বাড়ির তুলসী মঞ্চে উজ্জ্বল হবে মাটির প্রদীপ, কার্নিশে কার্নিশে আলোকিত হবে মোমবাতি, বাড়ির প্রতিটি কোন টুনি বাল্ব, এলইডি আলোয় প্রাণ ফিরে পাবে। তবে যে যাই বলুক, মাটির প্রদীপের মধ্যে যে পেলবতা এবং মাতৃত্ব আছে, তা পৃথিবীর সমস্ত আলোকে হার মানাবে। অমাবস্যার রাতে গ্রামবাংলার গৃহসজ্জায় জুড়ে বসে মাটির ছাঁচে তৈরি করা বিভিন্ন রকমের প্রদীপ। কখনও তা শঙ্খ, কখনও মাছ-কচ্ছপ, কখনও আবার লন্ঠন বা পদ্মফুল। মাটির প্রদীপে মিশে গেছে ফিউশন। বর্তমানকালের প্রদীপ মানেই যে শুধুমাত্র একমুখো বা পাঁচমুখো হবে এবং তাতে থাকবে সলতে পাকানোর মায়াবী আদর, তা নাও হতে পারে। অর্থাৎ চেনা ছক থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে, এই কর্পোরেট ব্যস্ততার জীবনে দুটোদিন নতুন মলাট পেতে শিল্পীরাও তাঁদের পছন্দমতো প্রদীপ নির্মাণে নেমে পড়েছেন।
আরও পড়ুন
বঙ্গদর্শন পুজোসংখ্যা, ১৪২৬
এবার প্রশ্ন হল, এলইডি লাইট নাকি মাটির প্রদীপ? দৌড়ে এগিয়ে কে? প্রতিবছরই এই প্রতিযোগিতা টানটান উত্তেজনার সামিল। মাঝখানে এই কয়েকবছর আবার ঢুকে পড়েছে চিনের আলো। যা প্রকৃত অর্থেই ভাতে মারছে মাটির প্রদীপ বানানো শিল্পীদের। কিন্তু তাতে কী! শিল্পীদের দেখার চোখে এক একটি নিজস্ব শিল্প হার মানতে নারাজ। তাই ২০১৯ সালের দীপাবলিতেও সারা বাংলা জুড়ে দেদার বিক্রি হচ্ছে মাটির প্রদীপ। শুধুমাত্র প্রবীণ প্রজন্মই যে তাতে অংশগ্রহণ করছেন এমন নয়, নবীনরাও দোকানে ভিড় করছেন। তা সমস্ত রিচুয়ালসের বাইরে গিয়ে আলোর উৎসবের দুইদিন নিজের মন প্রাণ ব্যতিরেকেও তার চারপাশের পরিবেশটাতে সাবেকিয়ানার রং ছেটাতে চাইছেন। আখেরে লাভ হচ্ছে প্রদীপ নির্মাতাদেরই।
চারিদিকে যখন রংমশাল, কালী পটকা, শব্দবাজি নিয়ে কড়া বাধানিষেধ, তখন দেশের প্রতিটি অন্ধকার দূর হয়ে যাক এই পরিবেশবান্ধব প্রদীপে। কলকাতার গড়িয়াহাটের এক প্রদীপ বিক্রেতা বাবলু মণ্ডল। গত দশদিন ধরে মাটির প্রদীপের পসরা সাজিয়ে বসছেন। জয়নগর থেকে কলকাতা। এটাই তাঁর এখন রোজকার রুটিং। কেমন বিক্রি হচ্ছে মাটির প্রদীপ? জিজ্ঞাসা করায় উত্তর দিলেন, “এই তো দাদা, গতবছরের তুলনায় অনেকটাই ভালো। সারাবছর অন্যান্য মাটির জিনিস তৈরি করি। কিন্তু নানান ধরনের প্রদীপ বানানোর নেশা ছোটো থেকেই। তাই কালীপুজোর আগের দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকি।” প্রতিদিন কতগুলো প্রদীপ বিক্রি হচ্ছে? “প্রায় ৭০টার উপর। ১৫ টাকা থেকে শুরু। বড়ো বড়ো প্রদীপের তুলনায় ছোটো একমুখী প্রদীপগুলোই বিক্রেতাদের টানছে বেশি।”
শুধুমাত্র বাবলু নয়, এরকম অসংখ্য বাবলুরা দীপাবলির ক’টা দিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। চোখে থাকে আলোর মতোই উজ্জ্বল স্বপ্ন। টাকা রোজগার করতে হবে, বাড়িতে গিয়ে সেই টাকা বড়োদের দিতে হবে কিংবা নিজের জন্যই না হয় একটু খরচ। তাঁরাও কিন্তু নিজেদের বাড়ি আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলেন। কেউ প্রদীপে তেল ঢালেন, কেউ দেন ঘি, কেউ সলতে পাকানোর কাজে বসেন, কেউ আবার স্থির আলোর দিকে তাকিয়ে... টুনি বাল্ব, এলইডি লাইট, চায়না আলোর মধ্যেও আজও মাটির প্রদীপের নস্টালজিয়াকে টক্কর দিতে পারেনি কেউ। এ কথা বলাই বাহুল্য।