No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বন্দুক ছেড়ে কলম ধরার আখ্যান

    বন্দুক ছেড়ে কলম ধরার আখ্যান

    Story image

    কিশোরবেলায় শ্যুটিং রেঞ্জে যে ছেলেটা বন্দুকে চোখ রেখে টিপ করত, যৌবনে পৌঁছে সে-ই প্রেমিকার কপালের ঘামে-ভেজা টিপ ছুঁয়ে দেখছে এখনও কবিতা ফোটে কিনা – দু’মলাট না থাকলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না। দু’মলাটের মধ্যেকার পাতাগুলো না-থাকলেও। অথচ এই যে জেনে যাওয়া গেল, এরপর ছেলেটার মুখোমুখি হলে কী বলব, জানি না। হয়তো কিছুই বলব না। বইটার দিকে আঙুল তুলে শুধু নামিয়ে নেব তৎক্ষণাৎ। নাহ্‌, এই বিস্তৃতির পক্ষে বইও নেহাৎ ক্ষীণ...
    বহুদিন আগে ফালগুনী রায় লিখেছিলেন – ‘ম্যাগাজিন শব্দটি আমি লক্ষ্য করেছি রাইফেল ও কবিতার সঙ্গে যুক্ত’। উনি শুধুই লক্ষ্য করেছিলেন, আকাশ জীবন্ত জীবাশ্ম হয়ে সাক্ষ্য দিল। আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়। তরুণ কবি হিসেবে যাকে চিনি। বন্ধু হিসেবে। পত্রিকা আর কবিতার বই নিয়ে ছুটোছুটি-করা ঈষত-স্থূল ছেলেটার হাতে বন্দুক – এই দৃশ্য কল্পনা করতেও অবাক লাগে। বিশেষত আমার এই মধ্যবিত্ত জীবন যখন দিন আনি দিন খাই-এর বাইরে সামান্য শব্দ বুনতে পেরেই অহংকারে ভোগে। সেখানে আকাশ কিশোর বয়সেই টানা দশ বছর রাইফেল শ্যুটিং করেছে, বাংলার প্রতিনিধি হিসেবে খেলেছে ভিনরাজ্যে। তারপর, সরে এসেছে একসময়। সেই খেলা ও না-খেলার অভিজ্ঞতা নিয়েই স্মৃতিচারণ। উঁহু, স্মৃতিতর্পণ। যা ছড়িয়ে আছে ‘অস্ত্র উপচার’ বইয়ে।

    শুধু রাইফেল শ্যুটিং নিয়ে থাকলে, ব্যক্তিগতভাবে কৌতূহল জাগত না। চিনতামই না হয়তো। কিন্তু খেলা ছেড়ে যখন কবিতার কাছে ফিরে এল, এবং ফিরে দেখল ফেলে-আসা দিনগুলো; খেলার অভিজ্ঞতা শুধুই বর্ণনা হয়ে রইল না। ‘গদ্যে লেখা কবিতা’ – তাও রাইফেল শ্যুটিং বিষয়ে – হ্যাঁ, আরও একবার বাংলার প্রতিনিধিত্ব করল আকাশ। ৯৮-৮৭-৯৮-৯২-৮৮-৯৬ নয়, সটান ও ঋজু ১০০-র লক্ষ্যভেদ এই গদ্যকারের। একসময় খেলার জন্য দিল্লি-আগ্রা-পুনে-পাঞ্জাব-গুজরাট চষে বেরিয়েছে উত্তরপাড়ার এই ছেলে, আর আজ তা নিয়ে লিখতে বসে নতজানু হচ্ছে কবিতার কাছেও – ‘দ্বিধায় রাখব তাকে এতটুকু মনের কুঠুরি / বরং স্নেহেই থাক, যন্ত্রণারা খুদকুঁড়ো খাক’।

    পাঠ-অনুভূতি যখন তীব্র হয়, প্রতিক্রিয়ার মনও অবশ হয়ে যায়। লিখতে চাইলেও জেগে থাকে শুধু শব্দ-ঘোর। আমার এই ব্যর্থতা আকাশের বইকে হয়তো উজ্জ্বলই করে আরও। যে-বই নিজেই ভরাট, তার প্রতিক্রিয়া লিখতে না-পারার জন্য নিজেকে ধন্যবাদ। বরং আকাশেরই দ্বারস্থ হই – ‘ভেবে দেখলে যে বয়সে বন্দুক ধরেছি, আমাদের মতো সাধারণ ঘরের ছেলেরা কাচের বাসন রাখার আলমারি ধরার অনুমতি পায় না সে বয়সে।’ কিংবা, ‘ব্লাইন্ডার দিয়ে বাঁ-চোখ ঢাকতে হয় ডানহাতি শ্যুটারদের। আমিও ব্যতিক্রম নই। অন্য চোখটি কখনো ফোর সাইট, রিয়ার সাইট হয়ে টার্গেট পেপারে, কখনো জানলার বাইরে দিয়ে তার গতিশীল মুদ্রার দিকে চেয়ে।’

    যেহেতু স্মৃতিতর্পণ, এ-বইয়ে খেলার প্রসঙ্গে এসেছে বিভিন্ন রাজ্যের কথা। সেখানকার পরিবেশ-সংস্কৃতি, মানুষজন এমনকি ড্রাইভারের কথাও বাদ দেয়নি আকাশ। এতদিন পরে লিখতে বসে, অতীত থেকে দানাপানি খুঁটে তুলতে গিয়ে আকাশও যেন অভিজ্ঞতার কাছে মুখ নামিয়েছে সেই ভিখারির মতো, যাকে সে দেখেছিল পায়রার জন্য ছিটিয়ে দেওয়া গমের দানা খেতে। আর, দুটি অংশে বিভক্ত এই বইয়ে খেলোয়াড়-জীবন থেকে কবিতার জগতে ঢুকে যাওয়ার যে আপাত-সংযোগহীন গদ্যগুলি, জীবন সেতু বেঁধেছে সেখানে। যে-সেতুতে আমরা কেউ পা রাখার কথা চিন্তাও করতে পারি না। শুধু তাকিয়ে থাকি, আর অব্যক্ত এক ‘বাহ্‌’ কার্তুজের মতোই কখন বেরিয়ে আসে হৃদয় ফুঁড়ে।
      
    শেষে, গোপন একটা স্বপ্ন জানাই নিজের। পূরণের প্রত্যাশা না-রেখেও দেখা যায় বলেই শব্দটার মধ্যে প্রাণ আছে আজও। আমার কারণে, বিদেশের মাটিতে যেন একবার... একবার অন্তত জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠে। ‘জনগণমন’। এও জানি, এ-স্বপ্নের কোনো পরিণতি নেই। ‘আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি’ – পড়েছিলাম কোথাও একটা। আবুল হাসানের লেখা কি?
    আমি না-পারি, আকাশ যেন পারে। ও যেন খেলায় ফিরে আসে। যদি কখনও, কোনো দুর্লভ মুহূর্তেও ওর মধ্যে দিয়ে নিজের স্বপ্নটাকে ছুঁতে পারি, শান্তি পাব। সেদিন আবার নিয়ে বসব বইটা। পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে চিৎকার করে বলব – কবি যখন হাতে বন্দুক তুলে নেয়, দ্যাখো, অসম্ভবও হাঁটু মুড়ে বসে ক্ষমা চায়, চাইতে তাকে হয়ই...

    ‘অস্ত্র উপচার’ সেই অপেক্ষার রসদ হয়ে থাক আপাতত।
     

    অস্ত্র উপচার – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
    প্রকাশক – তবুও প্রয়াস প্রকাশনী
    প্রথম প্রকাশ – জুলাই ২০১৮
    মূল্য – ১২৫ টাকা

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @