রবীন্দ্রনাথের শেষ ওষুধ

‘... ছেলেবেলা থেকে তিনি লড়েছেন কুস্তি, সাঁতরে এপার-ওপার করেছেন পদ্মা, ঘোড়া ছুটিয়েছেন প্রবল আনন্দে। সংগীত ও সাহিত্যচর্চার সঙ্গে সমানে চলেছে স্বাস্থ্যচর্চা। তাই এমন মজবুত শরীরে অসুখ সহজে এসে আক্রমণ করতে পারেনি। তিনি নিজেই বলেছেন : শরীর এত বিশ্রী রকমের ভালো ছিল যে, ইস্কুল পালাবার ঝোঁক যখন হায়রান করে দিত, তখনও শরীরে কোনরকম জুলুমের জোরেও ব্যামো ঘটাতে পারত না। জুতো জলে ভিজিয়ে বেড়ালুম সারাদিন, সর্দি হল না। কার্তিক মাসে খোলা ছাদে শুয়েছি, চুল জামা গেছে ভিজে, গলার মধ্যে একটু ঘুসঘুসনি কাশিরও সাড়া পাওয়া যায়নি। আর পেট কামড়ানি বলে ভেতরে ভেতরে বদহজমের যে একটা তাগিদ পাওয়া যায় সেটা বুঝতে পাইনি পেটে, কেবল দরকারমত মুখে জানিয়েছি মায়ের কাছে।’
কিন্তু এহেন রবিজীবনের শেষ বেলাকার ছবিটি বড়ই করুণ ও যন্ত্রণার। মন এবং শরীর দুই-ই তখন পদে পদে তাঁকে যেন যন্ত্রণা দিতেই বেশি উৎসাহী। জগদীশচন্দ্র বসু, গগনেন্দ্রনাথ বা সুরেন ঠাকুরদের মতো প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ আর ঘন ঘন রোগের প্রকোপে বিধ্বস্ত কবি। শেষে শরীরটাকে ঠেলতে ঠেলতে কোনও মতে শান্তিনিকেতন থেকে নিয়ে আসা কলকাতায়, নিজ নিবাস জোড়াসাঁকোতে। সেটা ১৯৪১। ঝকঝকে ডাক্তাররা দেখছেন কবিকে। স্যার নীলরতন সরকার, বিধানচন্দ্র রায়, ললিতমোহন ব্যানার্জি, সত্যসখা মৈত্র সহ আরও অনেকে। সবাই চান, কবি সুস্থ হয়ে উঠুন। সেইমতো, নানা মত-অমতের পর সর্বশেষ পরামর্শটি এল - অপারশন করাতে হবে। বারণ করলেন কবি। এমনও বলেছেন যে, সাবধানের যেমন মার নেই, মারেও তেমন সাবধান নেই। কিন্তু সে-কথা শোনার অবকাশ নেই চিকিৎসকমণ্ডলীর। তাই রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুমতি নিয়ে অপারেশন হল। কিন্তু তার চার-পাঁচদিন পর থেকেই শুরু হয়ে গেল স্বাস্থ্যের প্রবল অবনতি। সেই অবনতির শেষক’টা দিনের সাক্ষী আজও বহন করে চলেছে কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলের একটি ওষুধের দোকান। কবির যন্ত্রণার উপশমের ওষুধপত্রের এক নিবিড় আঁতুরঘর। আশ্চর্য দোকানের নাম। কোনও মেডিক্যাল বা ফার্মেসি নয়, দেশাত্ববোধের গন্ধ মাখা। ‘মহাত্মা অ্যান্ড কোং’। যে দোকানে তৈরি হত কবিজীবনের শেষবেলাকার মিক্সচার। আসলে ততদিনে বাঘা বাঘা ডাক্তারদের নামি দামি ওষুধগুলো ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। তখন একটু যন্ত্রণা উপশমের জন্য ডাক্তাররা বেছে নিয়েছিলেন মিক্সচার প্রয়োগের পথ। আর সেই মিক্সচার তৈরির দায়িত্বে ছিলেন এই দোকানেরই অভিজ্ঞ কম্পাউন্ডাররা।
আরও পড়ুন
গ্র্যান্ড হোটেলে কবি বিভ্রাট
পিল সাইট্রাস, সোডিবাই কার্ব, পট এসিডাস, সিরাপ রোজ কিম্বা হাইড্রাগ, মেনথল, একুল বেলাডোনা, নাসিভম ইত্যাদির জটিল মাপজোক দিয়ে মিক্সচার তৈরিতে দিনরাত এক করে লেগে পড়েছেন তাঁরা। কারণ, মুহুর্মূহু বদলে যাচ্ছে কবির স্বাস্থ্য পরিস্থিতি আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে ওষুধের রসায়নও। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
দোকানের পুরনো যারা আছেন তাঁরা হলেন শম্ভুনাথ রায় আর রণজিৎকুমার রায়। ওঁদের পূর্বপুরুষ রাধাবিনোদ রায় ছিলেন এই দোকানের প্রতিষ্ঠাতা। ওঁরা দু’জনেই কথায় কথায় বলেছিলেন - ‘আজও আমরা অগস্ট মাস এলে মনমরা হয়ে থাকি। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি চিৎপুর রোডের দিকে। চোখে ভাসে মানুষের ঢল, সেটা ৭৭ বছর আগের কথা। দৃশ্যটা কল্পনা করি হাতে এই প্রেসক্রিপশনের ছবি নিয়ে।’
তথ্যসূত্র- ‘সূর্যাস্তের আগে রবীন্দ্রনাথ’ – অমিতাভ চৌধুরী
কৃতজ্ঞতা স্বীকার- মহাত্মা অ্যান্ড কোং এর কর্তৃপক্ষ