No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    সবুজের দেশ - লাচুং

    সবুজের দেশ - লাচুং

    Story image

    প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পাহাড়ি পথ বেয়ে চলতে চলতে যখন দূর থেকে গ্রামটা কে দেখতে পেলাম; তখন সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিমে।  ঘড়ির কাঁটাতে  ৫:৩০টা।  টিনের চাল-দেওয়া ছোট্ট কাঠের হোটেল। ঘরে কোনও জানলা নেই।  একটাই দরজা। বারান্দার কোণে একটা ফুলের গাছ তার শাখা-প্রশাখা নিয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে ভিতরে। সবে বসন্ত শেষ হয়ে বৈশাখের শুরু। গাছ ছেয়ে আছে ছোট-ছোট সবুজ কুঁড়িতে।

    কিভাবে পৌঁছবেন
    নিউ-জলপাইগুড়ি রেলস্টেশন বা বাগডোগড়া বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সিতে লাচুং যাওয়া যায়। তবে স্টেশন বা বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি তে গ্যাংটকে এসে এক রাত কাটিয়ে পরদিন লাচুং যাওয়াই ভালো। গ্যাংটক থেকে বাস ও ট্যাক্সি পাওয়া যায় সব সময়।
    গ্যাংটক- লাচুং: ১০০কিমি (৩ঘণ্টা)
    বাগডোগড়া- লাচুং: ২০০কিমি (৪ঘণ্টা)
    নিউ জলপাইগুড়ি-লাচুং: ২২৮কিমি (৫ঘণ্টা)
    দার্জিলিং-লাচুং: ১৭০কিমি (৪ঘণ্টা)
    ইয়ামসামডাং যাওয়ার আয়োজন হোটেল থেকে করা যায়।

    চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম লাচুং গ্রামটাকে। পৃথিবীর সমস্ত সবুজ রঙ বুঝি এখানে এসে জড়ো হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন আপন খেয়ালে ক্যানভাসে এঁকে দিয়ে গেছে এই সবুজ চাদরে ঢাকা উপত্যকাটা। চারিদিকে সবুজ কর্ণিফার– ঘেরা পাহাড়। তার উপরে ছোট-ছোট কাঠের বাড়ি এদিক ওদিক ছড়ানো।  বহু দূরে অনেক উঁচুতে সাদা তুষারে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া। দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে পড়ছে ওর গায়ে। চিকচিক করে উঠছে। শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ের কোলে।

    আসলে কিছু কিছু শহর থাকে যার নিজস্ব প্রাণ থাকে। চলার ছন্দ থাকে। লাচুংকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল সে যেন একজন কিশোরী- হাসছে-খেলছে- ছুটে-ছুটে চলেছে। আর পথের মাঝে মাঝে থেমে শ্বাস নিচ্ছে-  দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে দু’পাশের দৃশ্যকে। কোনও কিছুরই কোনও তাড়া নেই। ‘ব্যস্ততা নেই কো আর…।’

    পরদিন যখন ঘুম থেকে উঠলাম; তখনও সমস্ত শহর ঘুমিয়ে। পূর্ব দিক বলে সূর্য ওঠে খুব তাড়াতাড়ি। আমরা যখন বেরোলাম তখন সকাল ৮:৩০টা। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে এখানে। সাথে ওলা। এখন আকাশ সম্পূর্ণ পরিষ্কার। শুধু গাছের পাতায় বিন্দু-বিন্দু শিশির। আমাদের হোটেলটা একটু নিচে। সামনে উঁচু পাথুরে রাস্তা বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেছে। রাস্তার দু’ধারে সরু নালা দিয়ে পরিষ্কার জল কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে। দেখলাম ছোট-ছোট ট্রাউট মাছ সেখানে খেলে বেড়াচ্ছে।

    আমরা এখন ৯০০০ ফিট উপরে। এখন চলেছি ৪৬ কিমি দূরে ১৫,৩০০ ফিট উপরে ইয়ামসামডাং-জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। আসলে সাধারণ পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে এই ইয়ামসামডাং পড়ে না। তাই আগেই গ্যাংটক থেকে আলাদা অনুমতি নেওয়া ছিল।

    লাচুং থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রা। চলেই যাচ্ছিলাম সোজা উপরের দিকে। পাকদণ্ডি বেয়ে। চড়াই-উতরাই ভেঙ্গে– এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। পথের দু’ধারে যে কত ধরণের রঙিন পাহাড়ি ফুল তা গুণে শেষ করা যাচ্ছিল না। একটা গোলাপি রঙের রোডোডেন্ড্রণ সমস্ত পথ ধরে ছিল আমাদের সঙ্গী। ওর নাম  ‘এজিলিয়াস’। একটা তীব্র গন্ধ তার। গুচ্ছ-গুচ্ছ ছেয়ে রেখেছে গাছগুলোতে।

    এর পর সবুজ হারিয়ে গেল সম্পূর্ণ ভাবে। এখন একপাশে উঁচু খাড়া পাহাড়। নীচে সাদা পাথুরে খাদ। আর খাদের ওপাশে সাদা বরফের পাহাড়। মনে হচ্ছিল যেন যুগ-যুগ ধরে চলে যাচ্ছি। ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি...।’ মন চাইছিল এ মনোরম পথ যেন কখনও না ফুরোয়। বহু নীচে ফেলে আসা নদী সরু থেকে আরও সরু হয়ে যাচ্ছিল। এক সময় হারিয়ে গেল চোখের আড়ালে। এর পরেই বরফ শুরু হল। রাস্তার দু’ধারে সাদা তুলোর মত বরফ ছড়িয়ে রয়েছে। বরফ যেখানে নেই; সেই সমস্ত পাথরগুলোতে সবুজ শ্যাওলা ধরেছে।

    জিরো পয়েন্টে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর ১২টা। এখানে পথটা শেষ হয়ে গেছে। এর পর আর কোনও রাস্তা নেই যাওয়ার। একটা উঁচু পাহাড় সামনে। স্বচ্ছ নীল আকাশ পাহাড়ের সীমানা ছুঁয়েছে। তার ওপারেই ‘চায়না’। এখানে কোনও জনবসতি নেই। গুটিকতক পর্যটক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এদিক ওদিক। চারিদিকে সাদা বরফ। সঙ্গে গা-হিম করা ঠাণ্ডা হাওয়া। কয়েক জায়গায় বরফ গলে-গলে সরু জলের ধারা তৈরি হয়েছে। আমরা বরফের উপর দিয়ে হেঁটে পাথরের উপরে গিয়ে বসলাম কিছু ক্ষণ। হঠাৎ মনে হল পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেন অন্য আরেক পৃথিবীতে এসে পড়েছি। হাওয়ার শব্দ টুকু ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। সমস্ত লোকচক্ষুর আড়ালে প্রকৃতি যে এত উদার ভাবে এত সৌন্দর্য ছড়িয়ে রাখতে পারে; তা সত্যি অবিশ্বাস্য! লাচুংকে যদি ছোট্ট কিশোরী মনেকরি; তবে ইয়ামসামডাং যেন তার কঠিন প্রেমিক। সব সৌন্দর্যই কি আর নদীর মত নরম হতে পারে? কিছু কিছু সৌন্দর্য থাকে যা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ইয়ামসামডাং সেই সৌন্দর্যের নাম।

    গুটিকতক মেয়েরা চা আর মোমো বিক্রি করছিল। ওরা লাচুং থেকে প্রতিদিন আসে এখানে বিক্রি করতে। দুপুর ১টার পর এখানে আর কাউকে থাকতে দেয় না। ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয় তখন। ওরাও নেমে আসে পর্যটকদের সাথে। আমরা যখন নামতে শুরু করলাম; তখন পর্যটকদের আর কেউ বাকি নেই। তাই চা-ওয়ালিগুলোও উঠে পড়ল আমাদের গাড়িতে। আবার চলতে শুরু করলাম –এবারে নীচের দিকে। "চরৈবতি...চরৈবতি।"

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @