বাংলার সেরা সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হত এক তেলের কোম্পানি থেকে

“কেশে মাখ ‘কুন্তলীন’।
রুমালেতে ‘দেলখোস’।
পানে খাও ‘তাম্বুলীন’।
ধন্য হোক এইচ বোস।
১৩৫২ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় এভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল বাঙালি উদ্যোগপতি হেমেন্দ্রমোহন বসুর কারখানায় তৈরি বিখ্যাত কুন্তলীন তেলের বিজ্ঞাপন। লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞাপনের নিচে রবি ঠাকুর এটাও লিখেছিলেন, “কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে নূতন কেশ হইয়াছে”। হেমেন্দ্রমোহন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয়। তবে নিছক বন্ধুত্বের খাতিরে রবি ঠাকুর হেমেন্দ্রমোহনের ব্যবসার গুণকীর্তন করেননি। আসলে রবীন্দ্রনাথ চাইতেন, দেশীয় শিল্প আরও বেশি করে প্রচারের আলোয় আসুক। তাই ভারতীয় শিল্পপতিদের বানানো পেনের কালি, ঘি, স্নো-পাউডার, এমনকি পাগলামির ওষুধের বিজ্ঞাপনেও নিজের নাম ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছেন।
কুন্তলীন তেল সম্পর্কে আরও কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, “কুন্তলীন তৈল আমরা দুইমাস কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার কোন আত্মীয়ের বহু দিন হইতে চুল উঠিয়া যাইতেছিল। কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে তাঁহার নূতন কেশোদ্গম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত, এবং ব্যবহার করিলে ইহার গন্ধ ক্রমে দুর্গন্ধে পরিণত হয় না”।
আরও পড়ুন
চৌরঙ্গীতে নিখোঁজ এশিয়ার প্রাচীনতম হোটেল
হেমেন্দ্রমোহন বসু তরুণ বয়েসে ডাক্তারি পড়তে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে চোখে অ্যাসিড ছিটকে পড়ায় অসুস্থতার জন্য কিছু স্থগিত রাখতে হয়েছিল লেখাপড়া। হেমেন্দ্রমোহনের নেশায় ছিল ব্যবসা। সুস্থ হয়ে আর তিনি ডাক্তারির দিকে গেলেন না। রসায়ন নিয়ে আগ্রহ ছিল এমনিতেই। নানান গন্ধদ্রব্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে করতে ১৮৯০ ‘কুন্তলীল কেশ’-এর ব্যবসা শুরু করলেন। তারপর এক এক করে তাঁরই হাত ধরে বাজারে আসতে থাকে ‘দেলখোস’, ‘ল্যাভেন্ডার ওয়াটার’, ‘ও-ডি কোলন’, ‘মিল্ক অব রোজ’-এর মতো সুগন্ধি দ্রব্য। বাঙালিদের মধ্যে প্রথম সাইকেল তৈরির কারখানা তিনিই খুলেছিলেন। স্থাপন করেন গ্রেট ইস্টার্ন মোটর কোম্পানি। দেশের প্রথম গ্রামাফোন রেকর্ডের কারখানাও খুলেছিলেন হেমেন্দ্রমোহন।
১৯০০ সাল নাগাদ হেমেন্দ্রমোহন বসু চালু করেন ‘কুন্তলীন প্রেস’। সেটি ছিল ছাপাখানা সহ এক প্রকাশনা সংস্থা। সেখানেই ছিল ভারতের প্রথম মনোটাইপ আর লাইনোটাইপ ছাপার ব্যবস্থা। ছাপাখানার অফিস ছিল বৌবাজার স্ট্রিটে, আর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে তৈরি হত এই ছাপাখানার ব্লক। কুন্তলীন তেল আর দেলখোসের প্রচার যাতে বাড়ে, সেই উদ্দেশ্যে হেমেন্দ্রমোহন শুরু করলেন ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ দেওয়ার প্রথা। বাংলায় এটিই প্রথম বস্তুপণ্যের প্রচারে সাহিত্যপুরস্কার। এটিরও সহায়তায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “তেলে-জলে কখনও মেশে না, কিন্তু তবুও একথা মানতেই হয় যে অন্তত একটি তেল আমাদের সাহিত্যরূপ জলের সঙ্গে নিতান্ত নিগূঢ় ভাবেই মিশে আছে। সেটি কুন্তলীন”।
এই পুরস্কারের জন্য গল্প লেখার প্রতিযোগিতা হত। প্রথম স্থানাধিকারী পেতেন ১০০ টাকা। তবে সে গল্প লেখার একটি বিশেষ শর্ত ছিল, “গল্পের সৌন্দর্য কিছুমাত্র নষ্ট না করিয়া কৌশলে কুন্তলীন এবং এসেন্স দেলখোসের অবতারণা করিতে হইবে, অথচ কোনো প্রকারে ইহাদের বিজ্ঞাপন বিবেচিত না হয়”। ১৯০৩ সালে প্রথম ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ পেল ‘নিরুদ্দেশের কাহিনি’ নামের গল্প। লেখকের নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে জানা গেছে, সেই গল্প লিখেছিলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। গল্প লিখে ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ পাওয়া তখন খুব সম্মানের ব্যাপার ছিল। এই পুরস্কার প্রাপকদের তখনকার বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকরা সমীহ করতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘মন্দির’ এই পুরস্কার লাভ করেছিল। এখনকার ‘সাহিত্য অকাডেমি পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ এবং অন্যান্য সাহিত্য পুরস্কারও সেই ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ থেকেই অনুপ্রাণিত।
তথ্যঋণ - কুন্তলীন গল্প-শতক: বারিদবরণ ঘোষ সম্পাদিত, আনন্দ পাবলিশার্স