রেলপথে সরাসরি ‘কলকাতা টু লন্ডন’!

লন্ডন থেকে কলকাতা রেলপথে ভ্রমণ! ভাবেননি সম্ভব হবে কোনোদিন? ভুল ভেবেছেন। আজকাল সবই সম্ভব। কিছু শর্ত অবশ্যই আছে। যেমন ধরুন, আপনার হাতে চব্বিশ দিন সময় থাকতে হবে। অকারণ টাকা খরচের মতো জোরদার ট্যাঁক থাকতে হবে। রেলের প্রতি তীব্র প্রেম থাকতে হবে। আর বিমানকে একেবারেই নাকচ করতে হবে। তাহলেই কলকাতা টু লন্ডন, লন্ডন টু কলকাতা- রেলপথে যাতায়াত সম্ভব। কীভাবে? এই ধরুন, আপনি কলকাতা থেকে গেলেন দিল্লি। সেখান থেকে অমৃতসর, তারপর লাহোর। লাহোর হয়ে কোয়েটা। সেখান থেকে জাহেদান। তারপর তেহরান, আংকারা হয়ে ইস্তাম্বুল। সেখান থেকে বুলগেরিয়া-সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়া-ভিয়েনা-অস্ট্রিয়া-মিউনিখ-প্যারিস হয়ে লন্ডন। কী ভাবছেন? পাগলের প্রলাপ? তা পাগলামিই বটে। অথচ এই পাগলামির নেশা একদিন ছড়িয়ে পড়েছিল লন্ডন থেকে কলকাতা পর্যন্ত।
ইংল্যান্ডের সাধের উপনিবেশ ভারতবর্ষ। ভারতের প্রতি তাদের গভীর মায়া। আর মায়া থাকলে মায়ার বাঁধনও থাকে। বড়ো শক্ত সে বাঁধন। গোটা দেশজুড়ে রেলপথের লৌহবাঁধনের সূচনা তো ইংরেজ আমলেই। গমগম ঝমঝম শব্দে ‘লৌহনিশ্বাসী রথ’ এদেশের মাটি কাঁপিয়ে চলেছে। আর যত কালোকুলো মানুষ অবাক-চোখে দেখছে তার ভয়াবহ তেজ।
“কাঞ্চীপুর বর্দ্ধমান ছয় মাসের পথ।
ছয় দিনে উতরিল অশ্ব মনোরথ।।”
‘বিদ্যাসুন্দর’-এর এই আশ্চর্য কথা যেন সত্যি হয়ে উঠল রেলপথের ফলে। ইংরেজরা বড়ো সাধ করে এ’দেশে রেলপথ বসাল। ভারতবর্ষ তাদের কাছে সোনার দেশ। যতই এখানকার আবহাওয়া বা নানান অজানা রোগের প্রকোপে তারা অকালে প্রাণ হারান না কেন। এখানকার সস্তা শ্রমিক, কাঁচামালের সুলভতা-- সবমিলিয়ে ব্রিটিশবাবুর আয় আকাশছোঁয়া। সেই লাভের লোভেই হোক বা ভালোবাসাতেই হোক, একদা কিছু ব্রিটিশ পরিকল্পনা করেছিল, লন্ডন থেকে ভারত অবধি রেলপথ বসানোর। স্থলপথে পৌঁছে যেতে চেয়েছিলেন তারা, টেমসের তীর থেকে গঙ্গাতীরে।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নাকি ইংল্যান্ডে এই নিয়ে প্রবল গবেষণা। এখানে সংবাদ প্রভাকরে সেই গবেষণার একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ পায়। স্যার এডওয়ার্ড ওয়াটকিনের কাছে কয়েকজন বিখ্যাত এঞ্জিনিয়ার এমন প্রস্তাব রেখেছিলেন। লন্ডন থেকে গাড়িবদলের ঝক্কি এড়িয়ে সোজা ভারতে পৌঁছনোর নকশা তৈরি করেছিলেন তারা। মানে জলপথে নৌকো বা জাহাজে চড়ার প্রয়োজন থাকবে না।
প্রস্তাবিত সেই রেলপথে ভূমধ্যসাগরের ওপর ছিল একটি ঝুলন্ত সেতুর কল্পনা। তার ওপর দিয়ে ছুটবে ঝমাঝম ট্রেন। এইভাবে ইউরোপ পেরিয়ে আফ্রিকা মহাদেশ। আর তারপর আফ্রিকার উত্তর দিক থেকে পূর্ব দিক বরাবর টানা রেললাইন। তাতেই ভারতের দরজায় পৌঁছনো। অবশ্য এই প্রস্তাব খারিজ হয়েছিল অচিরেই। ভূমধ্যসাগরের ওপর রেলপথ স্থাপন আর তারপর সুবিশাল আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে রেলপথের বিস্তার - নিতান্তই অসম্ভব মনে হয়েছিল।
তবে এখানেই শেষ নয়। লন্ডন থেকে তুরস্ক পর্যন্ত রেলপথ ছিলই। সেখান থেকে পারস্য অবধি রেলপথ তৈরির চেষ্টা হয় উনিশ শতকে। আর কেবলি আলোচনা হতে থাকে, পারস্য থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত রেললাইন বিস্তারের। তাহলেই সামনে ভারতবর্ষ। জলপথের নানান বিপদ। কখনো দস্যু তো কখনো ঝড়ঝাপটা, জাহাজডুবি। তা থেকে ঢের সুরক্ষিত যাত্রাপথ রেলের। তাছাড়া সময়ও বাঁচবে। তাই এই প্রস্তাব বারবারই পেশ হতে থাকে ইংল্যান্ডের দরবারে। মাত্র আটদিনেই নাকি পৌছনো যাবে লন্ডন থেকে কলকাতা। আর মাথাপিছু খরচ মাত্র একশো টাকা।
আরো পড়ুন
প্রথম বাঙালি কোটিপতির গল্প
নাহ, এই স্বপ্ন শেষপর্যন্ত অধরাই থেকে যায়। তাতে অবশ্য ভালোই হয়। নইলে কত কত নদী সমুদ্র যে বাঁধা পড়ত-- তার ইয়ত্তা নেই। তবে, রেলপথ কলকাতাবাসীর মনে রীতিমতো হিল্লোল তুলেছিল। অক্ষয়কুমার দত্ত নাকি কুড়ি পাতার একটি পুস্তিকাই লিখে ফেলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। তার নাম ছিল- ‘বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ’। সেখানে রেল কত ভালো, কত দ্রুত যোগাযোগ করা যায় দূরের মানুষের সঙ্গে-- ইত্যাদি নানা প্রশংসাবাক্য ছিল। আর ছিল রেলে যাতায়াতের নিয়মাবলি। তাতে কখন কীভাবে ট্রেনে ওঠা উচিত, কীভাবে দুর্ঘটনা এড়ানো উচিত- এইসব নানান নিয়ম লেখা ছিল। এইসব এখনও স্টেশনে বা ট্রেনে আটকে দিলে ভুল হবে না।
রেলের এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা থেকে বোঝা যায়, লন্ডন-কলকাতা রেলপথ আরোই আনন্দ দিত এই শহরকে। রেলগাড়িকে নিয়ে এমনিতেই আমাদের উপচানো আবেগ। তাই কবিতায় উপন্যাসে গপ্পে- রেলপথ ছুটে বেড়ায়। তবে ইদানিং নিন্দুকেরা বলছে, সেসব আবেগের দিন নাকি ফুরোতে চলেছে। কোম্পানি যেমন বেঁধেছিল রেলের পথ। তেমনি নাকি এত বছর পর ভারতীয় রেল চলে যাচ্ছে কোনো এক কোম্পানির জিম্মায়। তাতে এতই মহার্ঘ হবে রেলযাত্রা, যে আবেগের জারিজুরি মুখ থুবড়ে পড়বে।
ঋণ : রেলগাড়ি: বাষ্পীয় রথ থেকে মেট্রো, অভিজিৎ চক্রবর্তী, প্রতিক্ষণ