যে সংগ্রহশালার পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ

‘কোন মেস্তরি নাও বানাইলো এমন দেখা যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়’। বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানের কথা যেন এক প্রাচীন নদীর স্রোত, যেখানে টলোমলো নৌকা ক্রমশ বিলীন হয় দিগন্তরেখায়। বাংলার নদ-নদী জুড়ে যুগ-যুগ ধরে বইছে ভাটিয়ালি গান, নৌকার গল্প, মাঝিমাল্লার বেদনা, সুপ্ত প্রেম। ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখায় আমরা দেখি উদ্বাস্তু জীবনের অদম্য লড়াইগুলো, তিলতিল করে বাঁচার ইচ্ছেগুলো, নদীর এপার-ওপার মিলেমিশে এক বিরাট পৃথিবী তৈরি করে। সেই ব্যাপ্তিতে ভেসে বেড়ায় নৌকা, ছইয়ের ভেতরে দোলে লণ্ঠন। কংক্রিটের শহরে বসে এইসব দৃশ্য অবশ্য নেহাতই কষ্টকল্পনা। কিন্তু, যদি বলি খোদ এই শহরের বুকেই আছে এমন এক জায়গা, যেখানে গেলে বিগত শতকের নৌকাগুলো একসঙ্গে দেখা যায়। কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় মাঝিমাল্লাদের ভাব-ভালোবাসার স্পন্দন?
উত্তর-মধ্য কলকাতার ফুলবাগানের মোড় থেকে দুটো স্টপেজ। ভি.আই.পি রোডের ওপর আম্বেদকর ভবন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনগ্রসর জনজাতি কল্যাণ দফতরের (Backward Classes and Welfare Department) অধীনে এই বাড়িটিতেই আছে বোট মিউজিয়াম বা নৌকার সংগ্রহশালা। দুই বাংলার এবং অন্যান্য রাজ্যের হরেকরকম নৌকার মিনিয়েচার মডেল নিয়ে এই মিউজিয়ামে গেলে স্তম্ভিত হতে হয়। এত অমূল্য সম্ভার! কলকাতার বুকে এই মিউজিয়ামের হদিশ কিন্তু খুব বেশি মানুষ জানেন না। দুঃখের বিষয়, প্রায় প্রত্যেক দিনই এটি ফাঁকা পড়ে থাকে। মাঝেসাঝে মাত্র দু-তিনজন দর্শক মিউজিয়ামটি ঘুরতে যায়। এমন একটি বিরল মিউজিয়ামকে কেন্দ্র করে যতটা উৎসাহ থাকা উচিত মানুষের মধ্যে, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। তবে আপাতত এইসব নদীজাত দুঃখের কথা থাক। সংগ্রহশালা প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা বলি।
এখানকার সংগ্রহ এতই বিপুল যে এই স্বল্প পরিসরে তা নিয়ে লেখা অসম্ভব। ছোটো-ছোটো মডেলের নৌকা, মূলত কাঠ, প্লাই আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো, ঘরের মধ্যে একটা মায়াবি আলোয় বিভিন্ন কাঁচের বাক্সে সুসজ্জিত। অন্যতম উল্লেখযোগ্য হল রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত পদ্মাবোট। ১৮৯০-৯১ নাগাদ কবিগুরু এই নৌকায় বসেই পদ্মা নদীকে সাক্ষী রেখে রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি কবিতা, লিখেছেন দিনলিপি, চিঠি, গান। আমাদের মধ্যে অনেক শহুরের মানুষই ছোটবেলায় দাদু-দিদাদের কাছে খেয়া নৌকার গল্প শুনেছেন। কেমনভাবে নদীর এপার থেকে ওপার জিনিসপত্র সরবরাহ হয়, রাতেরবেলায় কীভাবে ডাকাতরা সেইসব নৌকায় হানা দিয়ে লুঠ করত ইত্যাদি। সেই খেয়া নৌকার, বা এককথায় খেয়ার, একটি অপূর্ব মডেলও এখানে দেখতে পাওয়া যাবে। বাংলার জলধারায় এই নৌকা আজও বহন করে মানুষ, সামগ্রী, সংস্কৃতি। ‘ছিপ’ নৌকার কথা হয়তো অনেকেই শোনেননি, তবে টিভিতে, সিনেমায় এই নৌকা আমরা অনেকেই দেখেছি। নামেই স্পষ্ট, এই নৌকার আকৃতি একটি লম্বা ছিপের মতন। কয়েকটি ছিপ নৌকার দৈর্ঘ্য ৭৫ ফিট অবধি হয়। টিভিতে দেখা যায়, এই কথা বলার কারণ ছিপ নৌকা মূলত বোট রেসের জন্যে বহুল ব্যবহৃত। কেরালায় এই নৌকাগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয়। এই রাজ্যেও মুর্শিদাবাদ জেলায় নৌকা বাইচের উৎসবে ছিপ নৌকা ব্যবহার করা হয়।
দিনাজপুরের শিল্পীরা রাত-দিন অক্লান্ত খেটে নানা ধরণের নৌকার মিনিয়েচার মডেলগুলো বানিয়েছেন। সরকারের তরফ থেকে তাঁরা পেয়েছেন পূর্ণ সহযোগিতা আর স্বীকৃতি। মডেলগুলোর খুঁটিনাটি কাজ এতটাই সূক্ষ্ম আর নয়নাভিরাম, যে মনে হয় কর্মীরা মাঝি-মাল্লাদের দৈনন্দিন জীবনকথাও যেন বুনে দিয়েছেন।
তবে, মিউজিয়ামের হলঘরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ে-- একটা প্রমাণ সাইজের রঙিন নৌকা। ঘরের ঠিক মাঝখানে নদীর একটুকরো ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে। তার ছইয়ের লণ্ঠন অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয় মন।
সংগ্রহশালার আর একটি উল্লেখযোগ্য জিনিস হল সেখানে সংরক্ষিত সিন্ধু সভ্যতায় তৈরি করা মাটির তৈরি একটি কবচ। অল্প আগুনে সেঁকা সেই কবচটির গায়ে আঁকা আছে একটি নৌকা, তার ছইয়ের দু’পাশে দুটি পাখি, এক প্রান্তে বৈঠা। হারাপ্পা যুগের এই অভাবনীয় শিল্পকলা আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই।
আধিকারিক শম্পা চন্দ সিন্হা নানারকম নৌকা ও তার ইতিহাস নিয়ে আরও অনেক নতুন কথা বলে মিউজিয়াম ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটুকু উজ্জীবিত করে তোলেন। ডঃ প্রসেনজিত দেব বর্মন, যিনি সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের নির্দেশক, সংগ্রহশালাটি মানুষের মননে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত। এরপরেও এই সংগ্রহশালায় নদী-নৌকোর গন্ধে কেউ বিভোর হবেন না, এ অসম্ভব। আমাদের ভিতরেও যে নদীটি বইছে, তার জলে নৌকো ভাসানোও তো প্রয়োজন কখনো-কখনো।
আর একটি সংগ্রহের কথা না বললেই নয়। সংগ্রহশালার অন্যতম সম্পদ হল ফরাসি শিল্পীকৃত ময়ূরপঙ্খী নাওয়ের একটি এচিং। এচিং-এর অর্থ একটি মেটাল প্লেটে কোনও আকৃতি খোদাই করে শিল্পকর্ম। সংগ্রহশালায় ময়ূরপঙ্খী নৌকারও একটি সুন্দর মডেল আছে।
বোট মিউজিয়ামে যখন আপনার ভ্রমণ শেষ হবে, আর আপনি বাড়িমুখো, আপনি কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও অনুভব করবেন ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’।