No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    যৌনকর্মীদের সন্তান বলে সহানুভূতি নয়, ফুটবলের মাঠে ওঁরাই রাজা

    যৌনকর্মীদের সন্তান বলে সহানুভূতি নয়, ফুটবলের মাঠে ওঁরাই রাজা

    Story image

    ভাব-স্বভাবকে দূরে সরিয়ে ফুটবল আজও সব খেলার সেরা। ফুটবলের জনপ্রিয়তা কোনোদিন বিত্তবানদের ঘেরাটোপে আটকা পড়েনি। দারিদ্র্য নিয়েই ফুটবলে পা রেখেছিলেন পৃথিবীর দুই কিংবদন্তি। একজন ব্রাজিলে আঞ্চলিক ক্যাফেতে কাজ করে জীবন চালাতেন। ফুটবল কেনার মতো পয়সা ছিল না। তাই কাপড়ের দলা পেঁচিয়ে বল বানিয়ে খেলতেন তিনি। বিশ্ব তাঁকে চিনল পেলে নামে।

    দ্বিতীয় জন আর্জেন্টিনার দরিদ্র ও মাফিয়াদের শহর বুয়েনস আইরেসের বস্তিতে বেড়ে উঠছিলেন পায়ে ফুটবল নিয়ে। পৃথিবী তাঁকে জানল মারাদোনা নামে।

    ফুটবল বিশ্বব্যাপী সব স্তরেই বৈষম্য ঘুচিয়েছে চিরকাল। ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, ধর্ম-অধর্ম সব বিভেদ দূর করে ফুটবল। তাই এশিয়ার সর্ববৃহৎ যৌনপল্লি হিসেবে পরিচিত সোনাগাছিতে ফুটবলের আগমন নেহাৎ সময়ের অপেক্ষা বলাই যায়। যৌনকর্মীদের সন্তান বলে ফুটবল তাদের আলাদা করে দেখেনি। তাই সোনাগাছির অন্ধকার গলি থেকে পোল্যান্ড, ইংল্যান্ডে পৌঁছে গিয়েছে তারা। পৌঁছে গিয়েছে ডেনমার্কেও। এর নেপথ্যে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে তৈরি দুর্বার স্পোর্টস একাডেমি। যেখানে যৌনকর্মীদের সন্তানদের পাশাপাশি অনেক প্রান্তিক স্তর থেকে উঠে আসা মেধাবীরা ফুটবল খেলে। শবর, মুন্ডাদের পাশাপাশি ‘দিন আনি দিন খাই’ শ্রেণির সন্তানরাও ফুটবলের টানে হাজির হয়।

    কীভাবে শুরু এই ফুটবল খেলার? সময়টা ২০০৮-২০০৯ সাল। স্থান বারুইপুর, যৌনকর্মীদের সন্তানদের হোস্টেল। ১৫ অগাস্ট তাঁদের নিজেদের উদ্যোগে একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়েছিল। সেখানেই রেফারি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি-র কর্মী বিশ্বজিৎ মজুমদার। তিনি ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত থাকা একজন কৃতি মানুষ। এখানে তাঁর চোখে পড়ে বিস্তর প্রতিভা, যাঁরা একটু প্রশিক্ষণ পেলেই খেলার জগতে উজ্জ্বল ভবিষ্যতে পৌঁছে যেতে পারে। সেই শুরু। দুর্বারের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ স্মরজিৎ জানার উদ্যোগে বিশ্বজিৎ মজুমদার সপ্তাহে একদিন করে কোচিং করাতে শুরু করলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ বেড়েছে ফুটবলের প্রতি। বেড়েছে খেলার চাহিদা। এখন সপ্তাহে তিনদিন করে ফুটবল কোচিং করান বিশ্বজিৎ। এরপর ধীরে ধীরে ছেলে ও মেয়েদের আলাদা আলাদা দল তৈরি হল। সুনামের সঙ্গে চলল তাদের ফুটবল খেলা। শুরু হল দুর্বার স্পোর্টস একাডেমি-র জয়যাত্রা। যা পেয়েছে ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশনের (আইএফএ) স্বীকৃতি।

    যৌনকর্মীদের সন্তান বলে ফুটবল তাদের আলাদা করে দেখেনি। তাই সোনাগাছির অন্ধকার গলি থেকে পোল্যান্ড, ইংল্যান্ডে পৌঁছে গিয়েছে তারা। পৌঁছে গিয়েছে ডেনমার্কেও। এর নেপথ্যে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে তৈরি দুর্বার স্পোর্টস একাডেমি।

    অভাব অনটনের মধ্যেও পেলে, মারাদোনার স্বপ্ন দেখে প্রান্তিক সমাজের তরুণরা। এরকম তরুণ ফুটবলারদের গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছে ‘আমরা পদাতিক’। যৌনকর্মীদের সন্তানদের সংগঠন আমরা পদাতিক। এই সংগঠনের তরফে রতন দোলুই বঙ্গদর্শন.কম-কে বলেন, “সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই যৌনপল্লির সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। প্রতি বছর ১৬টি জায়গা থেকে এক একটা দল করে আমরা একটা ফুটবল খেলার আয়োজন করি। এর নাম পদাতিক ফুটবল টিম।”

    এবার ১৮ অগাস্ট পদাতিক ফুটবল লীগের খেলা শুরু হবে। সঙ্গে থাকবে মহিলাদের প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ। স্থান সোনাগাছির কাছে দর্জিপাড়া। রতন বলেন, “এর একটা উদ্দেশ্য আছে। যারা ভাল খেলবে, তাদের দুর্বার স্পোর্টস একাডেমিতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পেশাদার ফুটবলার হয়ে যাতে তারা সমাজের মূল স্তরে ফিরে যেতে পারে।”

    পদাতিক ফুটবল টিমের সাফল্য নজরকাড়া। দেশের বিভিন্ন স্থানে, যেমন নাগপুর, মুম্বই, বেঙ্গালুরুতে তারা খেলেছেন। বিদেশেও রয়েছে কৃতিত্বের সাক্ষী। ডেনমার্কে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম যুব টুর্নামেন্ট ডানা কাপে তাঁরা খেলেছে। পদাতিকের অনুর্ধ ১৩ টিম একবার মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের মতো নামী দলকে হারিয়ে আইএসএল চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল। অনেকে পেশাদার ফুটবলার হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেউ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবে প্রশিক্ষণ নিতে পেরেছে।

    কথা হচ্ছিল বিশ্বজিৎ মজুমদারের সঙ্গে। উন্নয়নশীল দেশে খেলোয়াড়দের অনেক বাধা কাটিয়ে এগোতে হয়। এ প্রসঙ্গে তাঁর আক্ষেপ, “স্পনসর না পেলে যে কোনোদিন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে এদের খেলাধুলো। খেলার পর একটু টিফিন কিংবা জার্সি, জুতো কেনার জন্যও অর্থ লাগে। সেগুলো সাহায্য না করতে পারলে খুব মুশকিল। অনেক প্রান্তিক পরিবারের মেয়েরা আসে। তাদের যাতায়াতের খরচটুকুও বোঝার মতো চাপে। খুব স্ট্রাগল করে এরা চলে।”

    তবে লড়াই করে ফুটবল পায়ে রাখার শপথ এদের সকলেরই। মেয়েরাও বাদ নেই। রক্ষণশীল সমাজে হাফ প্যান্ট পরে মেয়েদের ফুটবল খেলাটা বাঁকা চোখে তাকানোর মতো বিষয়ই বটে! তাই হোস্টেল ফেরত মেয়েরা বাড়ি গিয়ে আর ফুটবল অনুশীলন করতে পারত না। এরকম অনেক সমস্যা পেছনে ফেলে আজ দুর্বার স্পোর্টস একাডেমির ২৫ জন মেয়ে কন্যাশ্রী কাপেও অংশ নিচ্ছে। এছাড়াও নানা প্রদর্শনী ম্যাচেও অংশ নিচ্ছে দুর্বার প্রমীলা বাহিনী। 

    এত সাফল্য সত্ত্বেও চাপা যন্ত্রণা ঝরে পড়ে রতনের কণ্ঠস্বরে। সমাজ কি উদার হতে পারে না? সোনাগাছির চত্বর কি আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেস হয়ে উঠতে পারে না? যেখানে ফুটবলই একমাত্র মাপকাঠি। রতন বলেন,  “যৌনকর্মীদের সন্তান বলে সহানুভূতি চায় না তারা। চায় সাহায্য। সামাজিক বৈষম্য কাটিয়ে ওঠার জন্যই আমাদের নিজেদের দল তৈরি করতে হয়েছে নিজেদের পরিচয়ে।”

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @