২০০ বছরের পথে ভারতের প্রথম এবং বৃহত্তম কলকাতা রেসকোর্স

শনিবারের এক পড়ন্ত বিকেলে পৌঁছে গেছিলাম কলকাতা রেসকোর্সের মাঠে, রাজকীয় জুয়া খেলা দেখতে। আসলে জুয়ার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। সে কারণে জুয়া লিমিটলেস একটা বিষয়। রাজকীয় জুয়া দেখার আগ্রহ তৈরি হল, Lynn Deas-এর ‘Horse Racing in India: A Royal Legacy’ বইটি পড়ে। প্রবাদ আছে রেসের মাঠ যতটা দেয় তার থেকে উসুল করে নেয় অনেক বেশি। বিচিত্র রেসের মাঠের মানুষজন আর বিচিত্র তাঁদের অভিজ্ঞতা। এক অনন্য জগৎ। কত মানুষ কাজ করছেন, কত উন্মাদনা এই রেসকে ঘিরে। কেউ হারবেন, কেউ বা জিতবেন। কেউ সর্বস্ব খুইয়ে বের হয়ে যাবেন মাঠ থেকে। আবার কেউ কেউ জয়োল্লাসে ফেটে পড়বেন। কলকাতার রেসকোর্স ভারতের প্রথম এবং বৃহত্তম রেসকোর্স। যা তৈরি হয়েছিল ১৮২০ সালে। এর পরিচালনায় রয়েছে ‘রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব’। রাজা-মহারাজা ও ব্রিটিশদের এই রাজকীয় জুয়া খেলায় একবার লাগাম টানতে চেয়েছিলেন পশুপ্রেমী লর্ড ওয়েলস্লি। কিন্তু ওই কিছুদিন! তারপর যেই-কে-সেই। কলকাতা রেসকোর্সে ইংল্যন্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ থেকে ক্রিকেটার রবি শাস্ত্রী কে আসেননি! অনেক বিখ্যাত রথীমহারথীর ঘোড়া দৌড়েছে এখানে। এখনও দৌড়চ্ছে।
পুরাণ-সাহিত্যে অশ্বমেধের যজ্ঞের ঘোড়াকে কেন্দ্র করে যেমন ক্ষমতা প্রদর্শন করার রেওয়াজ ছিল, ঠিক তেমনই প্রাচীন ভারতবর্ষেও ঘোড়া ছিল ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রাচীন ভারতবর্ষে ঘোড়ার আমদানি হত পারস্য থেকে। চন্দ্রগুপ্তের সেনাবাহিনীতে ছিল লক্ষাধিক অশ্বারোহী সেনা। সুলতানি আমলে ঘোড়া ছিল সাম্রাজ্যের নীতিনির্ধারক। আর সেকারণে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি ঘোড়ার দাম বেঁধে দিয়েছিলেন। তৎকালীন দিনে ভালো ঘোড়ার দাম ছিল একশো স্বর্ণমুদ্রা। শোনা যায়, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ঘোড়া আসত পর্তুগাল থেকে। সে যুগে ঘোড়ার ব্যবহার কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই ছিল না, ঘোড়া ছিল বিনোদনেরও সেরা উপাদান। একাধিক কসরৎ চলত ঘোড়া নিয়ে, ;হত ঘোড়া-দৌড়। আর রাজা-মহারাজারা ছিলেন এই সব রাজকীয় ঘোড়া-দৌড়ের পৃষ্ঠপোষক। রাজতন্ত্র থাকতে থাকতে সেই ঘোড়া-দৌড়কে ব্রিটিশরা এক নতুন আঙ্গিকে পেশ করলেন। ‘হর্সরেস’ ঘিরে শুরু হল বাণিজ্যিক জুয়া। হর্সরেসের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। ১৭৭৭ নাগাদ মাদ্রাজে প্রথম হল ঘোড়া-দৌড়। ধীরেধীরে গড়ে উঠতে শুরু করল রেস ট্র্যাক। প্রতিষ্ঠা হল ‘বোম্বাই টার্ফ ক্লাবের’।
এদিকে বাংলায় পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই ইংরেজদের আধিপত্য বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর জন্য একাধিক বেস ক্যাম্প তৈরি করেছিল ব্রিটিশরা। আর সেই বেস-ক্যাম্পগুলিতে মাঝেমাঝেই সেনাবাহিনীর আধিকারিকরা অবসর সময়ে ঘোড়া দৌড়ের আয়োজন করতেন। জানা গেছে, কলকাতার কাছে ‘আকরা’ নামে এক জায়গায় প্রথম ঘোড়া দৌড় হয়েছিল। ধীরেধীরে কলকাতাতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হর্সরেস। গড়ে ওঠে বেঙ্গল জকি ক্লাব। বেঙ্গল জকি ক্লাবের সদস্যরা ময়দান চত্বরে অনুশীলন করত। এই ক্লাবের সঙ্গে ইংল্যান্ডের জকি ক্লাবের বেশ ভালো যোগাযোগ তৈরি হয়। তাদের উদ্যোগেই গড়ে ওঠে ‘ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব’। আর যে বছর কলকাতা রেসকোর্সের মাঠে ইংল্যন্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ এলেন দ্বিতীয়বার, রানি মেরিকে নিয়ে সে বছর থেকে ‘ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবে’র সঙ্গে যুক্ত হল ‘রয়্যাল’ শব্দটি। ‘ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবে’র নাম হল ‘রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব’।
রেসের মাঠের অনেক নিয়মকানুন। হুট করে চাইলেই যেকোনো জায়গায় ঢোকা যায় না, ছবি তোলা যায় না। আর রেস খেলারও আছে অনেক নিয়ম। রাজকীয় জুয়া বলে কথা! রেস ঘিরে আছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। যেমন- ভাইসরয় কাপ, ভিক্টোরিয়া কাপ, এয়ার ফোর্স কাপ। রেসে দৌড়ানো ঘোড়াদের বিভিন্ন নাম রয়েছে। জকিদেরও নাম রয়েছে। খেলা হয় মাঠের হিসেবে, যেমন ১১০০ মিটার, ১২০০ মিটার, ১৪০০ মিটার কিংবা ১৬০০ মিটার। বেশ কয়েক ধরনের খেলা হয়, যেমন- ঘোড়ার ওপর বাজি ধরে খেলা, জকির ওপর বাজি ধরে খেলা। তার জন্য রয়েছে টিকিট। সমস্ত কিছু হয় নিয়ম মেনে। আর রেসের মাঠে বাজির পরিমাণ! অকল্পনীয়। কারো কারো ঘোড়া আসে ফ্লাইটে করে। প্রশিক্ষিত সেসব ঘোড়ার দাম শুনলে চোখ কপালে উঠবে। কয়েক কোটি টাকার সেই সব ঘোড়ার জকিদের বেতনও লক্ষাধিক টাকা। আর আছে জকিদের মোটা টাকার ইনসিউরেন্স। ঘোড়া থেকে পড়ে যদি কোনো জকি মারা যান, তৎক্ষণাৎ তার পরিবার পেয়ে যান ইনসিউরেন্সের টাকা। রেস চলাকালীন ঘোড়ার সঙ্গে পাশের ট্র্যাকে ঘোরে প্রাইভেট নার্সিংহোমের অ্যাম্বুলেন্স, বিচারকের গাড়ি। কেউ ঘোড়া থেকে পড়ে জখম হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। আর বেড বুকিং থাকে তাঁদের। রেসের মাঠে ভারতের অনেক দিকপালের ঘোড়া দৌড়েছে। আর সে তালিকায় নাম রয়েছে অনেক নামী-দামী ক্রিকেটার, ব্যবসায়ী থেকে বিজয় মালিয়ার মত প্রভাবশালীর।
রেসের মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন অথচ মাঠে যাননি তার সংখ্যা কিন্তু বেশ কম। যতজন না খেলতে গেছেন মাঠে, তার থেকে বেশিজন গেছেন খেলা দেখতে। দশ টাকা দিয়ে আপনি খেলা শুরু করতে পারেন, মানে বাজি ধরতে পারেন আর শেষ? আগেই বলেছি লিমিটলেস। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত দুই গোয়েন্দা ‘ফেলুদা’ কিংবা ‘ব্যোমকেশ’-এ সেভাবে রেসের মাঠের কথা না থাকলেও শরদিন্দু ব্যোমকেশের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন, “কলকাতায় সেযুগে মদের ঠেকের থেকেও বড় নেশা ছিল রেসের মাঠে জুয়া খেলার।” সমরেশ মজুমদার অবশ্য নিজে যেতেন রেসের মাঠে, আর সে অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখে ফেলেছিলেন আস্ত একখানা উপন্যাস ‘দৌড়’। সাহিত্য বাদ দিয়ে সিনেমার জগতে রেসের মাঠের একাধিক দৃশ্য দেখা গেছে বিভিন্ন সিনেমায়। ‘শুধু একটি বছর’ সিনেমায় কলকাতা রেসকোর্সের মাঠে ভরা গ্যালারিতে ছিলেন উত্তম কুমার-সুপ্রিয়া দেবী। আবার সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে রেসের মাঠে দেখা গেছিল শর্মিলা ঠাকুরকে। ২০০ বছরের কলকাতা রেসকোর্সের অনেক গল্প, অনেক ইতিহাস, সবই ঠিক আছে। কিন্তু রেস যদি নেশায় পরিণত হয় তাহলে...!
তথ্য ঋণ- শান্তনু চক্রবর্তী।
ছবি- রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব।