আমাদের রাশিয়া ছিল রংবেরং-এর বইয়ের শৈশব

একসময় ঠাট্টা করে বলা হত, রাশিয়ায় বৃষ্টি হলে নাকি কলকাতার কমিউনিস্টরা এই শহরে ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটতেন। সেই রাশিয়াও নেই। সেই কমিউনিস্টরাই বা এখন কোথায়! এই অবস্থায়, এবারের কলকাতা বইমেলায় থিম কান্ট্রি রাশিয়া। একটা গেটও তৈরি হচ্ছে বলশয় থিয়েটারের আদলে। থাকছেন বেশ কয়েকজন রুশ সাহিত্যিক। এই মেলা উপলক্ষে কয়েকটি রুশ বইয়ের বাংলা অনুবাদ দেখতে পাওয়া যাবে রুশ প্যাভেলিয়নে। তার মধ্যে অন্তত দুটি শিশুপাঠ্য বই থাকছে বলেও খবর। এখনকার ছোটোরা জানে না। রাশিয়ার বই বললেই মনে পড়ে যায় আজ থেকে বেশ কয়েক দশক আগে মস্কো থেকে আসা বই-পত্রের কথা। আমাদের সেই ছোটোবেলা। অফুরন্ত ছিল রুশ বইয়ের সেই ভাণ্ডার। আমাদের ছোটোবেলায় যারা সোভিয়েত দেশে নামের পত্রিকার পৃষ্ঠা দিয়ে মলাট দেওয়া বই নিয়ে স্কুলে আসত, তাদের দেখে বেশ ঈর্ষাই হত। একটা অসুবিধে ছিল। ওই কাগজগুলোতে ফাউন্টেন পেন দিয়ে কিছু লেখা যেত না। কাগজ কালি শুষে ধেবড়ে যেত। একটু উঁচু ক্লাসে উঠে আমিও পাড়ার এক কাকুকে ধরে সোভিয়েত দেশ পড়তে শুরু করি। মলাটের জন্য পুরোনো সোভিয়েত দেশ পেতেও শুরু করি।
আরও পড়ুন
শঙ্খদা, এবারের বইমেলাতেও আপনি আসুন
সোভিয়েত দেশ পত্রিকায় খুব সুন্দর সুন্দর দেখতে সব পুরুষ, নারী শ্রমিকদের ছবি থাকত। তাদের সব ঝকঝকে পোশাক। তকতকে মেঝে। হাসি মুখ। তারা সুন্দর সুন্দর খাবার খাচ্ছে, হাসছে, বেড়াচ্ছে। ওদের নেতারা আমাদের নেতাদের মতো নয়। তারা শ্রমিকদের সঙ্গে ছবি তোলে। হ্যান্ডশেক করে। সেই সব কারখানায় প্রতিদিনই উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার গল্প বলে। মনের ভেতরে একটা স্বপ্নের দেশ জন্ম নিয়েছিল। তাদের কুকুর, গরু, সাইকেল, চায়ের কাপ, মেয়েদের গাউন, বাচ্চাদের টুপি, পোষা ভেড়া সবই ছিল দুর্দান্ত সুন্দর। এটা সেই সময়, যখন আমাদের পঞ্জিকায় বৃহৎ লাল মুলো, বা বড়ো বড়ো বাঁধাকপির বিজ্ঞাপন থাকত। বশীকরণ তাবিজ বিক্রি হত পাঁচ টাকায়। সরস্বতী পুজোর পরের দিন বেলপাতায় খাগের কলম দুধে চুবিয়ে লিখতে হত, ‘ওঁ সরস্বত্যৈ নমো’। আর সেই লেখা মোটেই ঠিকঠাক হত না বলে ভয় হত ঠাকুর বিদ্যে দেবে না। ভয় যে খুব অমূলক ছিল না, তা অবশ্য আজ হাড়ে হাড়ে টের পাই।
সেই সময় আমাদের চারপাশে সস্তায় ভালো বই বলতে ছিল অগুনতি রাশিয়ার বই-পত্র। জলের দরে কেনা যেত ওই সব চকচকে ঝকঝকে বই আর সোভিয়েত দেশ পত্রিকা। এক মুরগি মা তার চার ছানাকে নিয়ে মাঠে খাবার খুঁজছে। মাঠে একটা চিমনি পড়ে আছে। খেলতে খেলতে সেই চিমনির মধ্যে ঢুকে পড়ল চারটি মুরগির ছানা। এদিকে তাদের দেখতে না পেয়ে মা মুরগি বলছে, ‘হায়রে হায়রে হায়, ছানারা পোনারা সব গেল কোথায়’! এমন সময় চিমনির এক মুখ দিয়ে ঢুকে অন্য মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল চারটি ছানা মুরগি। কিন্তু ততক্ষণে তাদের গায়ের রং চিমনির কালি লেগে ভুসোকালো। মা মুরগি তাদের দেখে বলছে, ‘এরা তো আমার নয়’!। জলে পা ডুবিয়ে বক জলাশয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে মাছের আশায়। জলের নিচে দুটো বোকা ব্যাঙ বকের দুই পা-কে গাছের ডাল ভেবে তাতে দোলনা বেঁধে মনের সুখে দোল খাচ্ছে। এমন সময়, বক দেখলো কাছেই একটা ছোটো মাছ। অমনি ঠোঁট দিয়ে সেই মাছ মুখে নিয়ে বক দিল উড়ান। আকাশে পাখা মেলে চলেছে বক। তার পায়ের দড়িতে বসে ঝুলছে হতভম্ব দুই ব্যাঙ। এই হল ছবি। নিচে লেখা, ‘দোলনার দোল বেজায় সুখ, হুঁশ রেখো ভাই নইলে দুখ’। লেখক, নিকোলাই রাদলাভ।
তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এমন সব ছবিতে ভরা অসংখ্য বই বাজারে গড়াগড়ি খেত। প্রায় সবই বেশ উঁচু মানের লেখা। তার মধ্যে কিছু কিছু শব্দের অবশ্য তখন মানে বুঝতাম না। যেমন ‘নুনে জড়ানো পিঠে’, ‘পনির’ ইত্যাদি। হয়তো কলকাতায় থাকতাম না বলে। পনির আমরা দেখেছি অনেক পরে। প্রথম পড়া সোভিয়েতের ছোটোদের উপন্যাস আর্কাদি গাইদারের। নাম? মনে হয় ইস্কুল। সেই ছোট্ট ছেলেটা যার কুকুরকে খেলা শেখানোর তালিম দিতে গিয়ে ইস্কুলে যাওয়া হত না। কিন্তু তবু তাকে কেউ বকেনি। বা সেই ‘দাদুর দস্তানা’ বই। যে দস্তানায় একের পর এক সেঁধিয়ে যাচ্ছে সব্বাই।
কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ২০২০-র সাংবাদিক বৈঠক। ছবি সৌজন্যে- পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড।
আমাদের সময় স্কুলে ‘ইম্প অ্যান্ড দ্য পেজেন্টস ব্রেড’ নামে তলস্তয়ের একটা গল্প পড়ানো হত। এক হত দরিদ্র কৃষক। নিয়মিত পেট ভরে খেতে পায় না। তবু সে সবাইকে ভালোবাসে। দোষ করলে ক্ষমা করে দেয়। কখনও রাগ করে না। শয়তানকে পাঠানো হল ওকে লোভী আর হিংসুটে করে তোলার জন্য। শয়তান এসে ওর উৎপাদন বাড়িয়ে দিল। রোজগার বাড়িয়ে দিল। অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী করে তুলল। তারপর ধীরে ধীরে সেই কৃষক লোভী আরও হিংসুটে হয়ে উঠল। পরে হাতে এল আনা কারেনিনা, রেজারেকশান, ওয়ার অ্যান্ড পিস, দস্তয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, ইনসাল্টেড অ্যান্ড হিউমিলিয়েটেড, শোলোকভের অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দ্য ডন, তুর্গেনিভের অন দ্য ইভ। নিকোলাই গোগোলের ‘নাক’, আন্তন চেকভের ‘ডেথ অফ আ ক্লার্ক’ ছোটো গল্প পড়ে বিস্ময়ে রাতে ঘুমোতে না পারা। মায়াকভস্কির কবিতা। এই সব পড়তে পড়তে কলেজে পৌঁছে গেলাম। তারপর পড়লাম ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’। আজ থেকে ৪২-৪৩ বছর আগে ‘মা’ যে কতবার পড়েছি তা গুণে শেষ করা যাবে না। একটা কাজে কলকাতায় এসে দেখে ফেললাম, পুডফকিনের সিনেমা ‘মাদার’। ঘোর লেগে যাওয়ার মতো। আঙ্কল টমস কেবিন এবং মাদার বা মা, এই দুটি বই, এর সঙ্গে গোর্কির তিন খণ্ড আত্মজীবনী, আমাদের সময়ের বহু ছাত্র-ছাত্রীকে বাম রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল সেই সময়ে।
একটু পিছিয়ে যাই। ১৯৬১ সালে, সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি, থাকি ডুয়ার্সের নাগরাকাটায়, রবীন্দ্র শতবর্ষ উপলক্ষে আমাদের বাড়িতে এল গ্রামোফোন আর বেশ কিছু রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ড। লং-প্লে-তে শ্যামা। কানে সবসময় ভাসত, ‘ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে জানিনে...’। কিন্তু রবীন্দ্র রচনাবলীর নাগাল আমরা পাই তার বহুও পরে। তাতে মনে হয় ক্ষতিই হয়েছে। সে যাই হোক। সোভিয়েত সাহিত্য পড়তে পড়তে নিষিদ্ধ সোভিয়েত সাহিত্যও একটা হাতে এসে গেল। বু্দ্ধদেব বসুর তত্ত্বাবধানে মানব বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্ভবত হিমানী বন্দ্যোপাধ্যায়ও, তাঁদের অনুবাদ, ডক্টর জিভাগো। মনে আছে এক দিন সকাল সাতটায় পড়তে বসে সেই বই শেষ করতে ভোর চারটে হয়ে গিয়েছিল। চোখে জলও এসেছিল। মুগ্ধও। কেন জিভাগোর সোভিয়েতে কোনও স্বীকৃতি নেই তাও বুঝলাম।
নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ইস্পাত বলে দু’খণ্ডে একটা উপন্যাস তখন খুব হাতে হাতে ঘুরত। পরে নকশাল আন্দোলন শুরু হওয়ার পর চিন থেকে এল ইস্পাতের মতোই একটি উপন্যাস ‘বিপ্লবের গান’। লেখক চিন চিং মাই। বেশ খারাপ লেখা। তবু আমাদের বলতে শেখানো হল, ওটাই প্রকৃত বিপ্লবী বই। এখন ভাবলে বেশ হাসিই পায়। সেই সময় রাশিয়া থেকে প্রচুর অঙ্ক, মহাকাশ, জ্যামিতি, সাধারণ বিজ্ঞানের উপর খুব উঁচু মানের বই আসত। জলের দরে বিক্রি হত সেই বই। পতঙ্গ গবেষণার উপর, ‘ওরাও কথা বলে’ বইটির কথা কোনও দিন ভুলব না।
রুশ সোভিয়েতের পতন হয়েছে প্রায় ত্রিশ বছর হল। এসব বই হয়তো আর কোনও দিনই আসবে না, আগে যে ভাবে আসত। পুতিনের রাশিয়াতে ওই সব বইয়ের কদর কেমন, তা নিয়ে কোনও ধারণা নেই। তবু এবারের বইমেলায় থিম কান্ট্রি রাশিয়া শুনে এই সব রাশিয়ান বইয়ের স্মৃতি মনে ভেসে উঠল।