কলিকাতায় শিব দুর্গা

উত্তর কলকাতার বটতলা এলাকার চোরবাগান আর্ট স্টুডিয়ো থেকে প্রকাশ পেলো শিব-দুর্গার নয়া রঙিন লিথোগ্রাফের ছবি। যে সময় এমন ছবি বাজারে হৈচৈ বাঁধাল তখন কলকাতার ছবির বাজারে নতুন যুগের আলো। সেটা ১৮৭৮ সাল। নামজাদা শিল্পী অন্নদাপ্রসাদ বাগচি তাঁর কিছু সহ শিল্পীদের জুটিয়ে নিয়ে খুলে ফেললেন ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিয়ো। কার্যত ছবির ব্যবসা খুললেন তিনি। স্টুডিয়োর কার্যালয় হল বউবাজারে। লিথোগ্রাফে রঙিন তো বটেই তাছাড়া ছবির এমন বাস্তব গুণ দেখেও অবাক হল লোকে।
বউবাজারের স্টুডিয়োর এমন জনপ্রিয়তার দেখাদেখি কলকাতার কাঁসারিপাড়া, চোরবাগান নানা অঞ্চলে একই ধাঁচের স্টুডিয়ো খুলে বসার হিড়িক পড়ে গেল। কাঁসারিপাড়া, চোরবাগানের শিল্পীরা নিজেরাও তৈরি করে নিলেন হরেক কিসিমের গল্প। এঁরাও দেবদেবীদের গড়ন গঠনে এমন বাস্তবতার ছোঁয়া আনলেন যা কিনা কালীঘাটের পটকেও হার মানিয়ে দিল। দেবতারা আপামর লোকজনেদের চেনাশোনা পোশাকে এমন ভাবে ছবিতে বর্ণিত হলেন যাতে মনে হয় তাঁরা যেন আমাদেরই একজন। বলাই বাহুল্য এই সব স্টুডিয়োর শিল্পীরাও সকলেই কিন্তু তখনকার আর্ট স্কুল থেকে পাশ করে বেড়িয়েছেন। দেখা গেল এই শিল্পীরা তাঁদের ছবির গল্পের সূত্র পেয়ে গেলেন কলকাতার নবরসের সাহিত্য ধারা থেকে যার সঙ্গে নবনির্মিত রেলগাড়ির সম্পর্কও গেল জুড়ে।
তখন রেলপথ খুলেছে দেশের নানা প্রান্তে। হুতোম লিখলেন ‘দুর্গোৎসবের ছুটিতে হাওড়া হতে এলাহাবাদ পর্যন্ত রেলওয়ে খুলেচে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাল কালো অক্ষরে ছাপানো ইংরেজী বাঙ্গালায় এস্তেহার মারা গেছে; অনেকেই আমোদ করে বেড়াতে যাচ্ছেন - তীর্থ যাত্রীও বিস্তর...’। দুর্গাচরণের মতো সাহিত্যিকেরা দেখালেন রেলগাড়ি করে মর্ত্যে ভ্রমণ করছেন স্বর্গের দেবগণ। ঠিক এরকম সময় চোরবাগান আর্ট স্টুডিয়োর এই ছবিতে দেখা গেল কলকাতায় বেড়াতে এসেছেন শিব আর পার্বতী। আর তাঁরা সদ্য এসে বসে রয়েছেন গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে মানে হাওড়ায়। অর্থাৎ বুঝে নিতে অসুবিধে নেই যে শিব-পার্বতী হাওড়া অঞ্চলে এসে নেমেছেন রেলগাড়িটি চড়েই। গঙ্গার পূর্ব পাড়ে দেখা যাচ্ছে যে মসজিদের চেহারাটি সেটি নাখোদা মসজিদের মতো আর গির্জাটি চেহারায় চরিত্রে ঠিক যেন আরমানি গির্জা। চেহারার এই মিলগুলিই মনে করাতে চায় যে গঙ্গার ওপারটি কলকাতা। সাথে ছোট ছোট অভিনব রীতিনীতি। যেমন ধরা যাক শিব ঠাকুরের গোঁফের কথা। এমন গোঁফকে বাবু-রা আদর করে বলে থাকেন অ্যালবার্ট কাট গোঁফ। কারণ প্রিন্স অ্যালবার্টের গোঁফটিও ঠিক এমনই। পাশাপাশি বাস্তবতার ছোঁয়া এল পার্বতীর বসবার ভঙ্গিতেও। এক হাঁটু মুড়ে অমন বসার আটপৌরে ভঙ্গিটি শিল্পী তুলে এনেছেন বনেদি বাড়ির মেয়ে-বউদের ছায়া প্রচ্ছায়া মিশিয়ে। এই ভাবেই চলল কলোনিয়াল ইন্ডিয়ার সমান্তরালে ভারতের পুরাণ কাব্যের ছবি রচনার গল্প। এমন বাস্তবতার নিরিখ বাংলার চিত্রকলায় তখন নয়া যুগের নিশেন তুলল।