কবিতা-১

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রত্নপ্রস্তর
পাথরে উৎকীর্ণ রথ-
এশিরীয় প্রভুদের জমক প্রমাণ।
অ্যাজাক্স, এখানে তবে রাশ টেনে ধরো,
উল্লম্ফনে ঘোড়াগুলো ক্ষিপ্ত, তেজীয়ান।
পাথরে উৎকীর্ন ঘোড়া;
এটিলার বর্শা কার মুণ্ড ধরে আছে!
পাথরে উৎকীর্ণ ফুল; অগ্নিস্রাব, ঝড়ের সংকেত...
পাথরে উৎকীর্ণ বীণা, ড্রাগনের ল্যাজের ঝাপট...
পাথরে উৎকীর্ণ মুখ, ফুল হার, মগ্ন শিশুদল;
আত্মার রোমাঞ্চে প্রিয় বাঁশি হাতে উড়ে যায় কাসান্ড্রামহল।
পাথরে উৎকীর্ণ খুলি, স্কালর্যাকক- মায়া সভ্যতার,
তারই পাশে লোকালয়, সোপানের বছরপঞ্জিকা-
তার ওপাশে জলাশয়, গুণ্ঠিত ছায়াতরুতল,
সেখানে ডুবন্ত নারী- সংখ্যাতীত বলিদান,
কুবেরের বিষয় আশয়।
উৎকীর্ণ মুখোশ এত, যুযুধান দেবারিগণের!
তারও নীচে বামনের তিনখানি পা।
এদের আবর্তে বায়ু- প্রভঞ্জন, অগ্নি, মাটি, জল,
কাস্তে ও ধানের শীষ, বৃষভ, লাঙল।
সমুচ্চ পাথরখণ্ডে লিঙ্গ এক- প্রবল উথান,
সবার উপরে দীপ্ত চক্র সেই- সূর্য বলীয়ান।
ছায়াগ্রহ
আয়নায় মেডুসার মুখ
সর্পকেশী দেখে পারসিউস
শক্রপোত আরশি চমকায়
ইউরিদিকে মুকুরগহনে
কালো হাত সে-ই তো বাড়ায়
ছায়াগ্রহে মেঘ ভেসে যায়
(লা’জ দোর-এ), মেঘ লেগে আছে-
আয়নায়ঃ উৎপল-বচনে
ঋক্ষরজা সলিলদর্পণে-
নার্সিসাস যেমত মননে
বিধর্মীর নয়ন উৎসুক
পদ্মিনীর মুকুরে শ্রীরূপ
শুনকেও নিজের ছায়ায়
ঘেউ ঘেউ করে আয়নায়
দোটানা
ভাটা লাগে কথার জোয়ারে,
পুরু সর কফির কাপেও,
অথচ পিপাসা এত বাড়ে-
তবুও চুমুক নয় শ্রেয়।
গা গুলিয়ে উঠতেই পারে
শ্রীমান সরের কারণেও,
ফেনা জমে পেয়ালার ধারে,
ঘ্রাণ শুধু হল উপাদেয়।
লব্জ আজ নিশুতি শানায়-
ক্রিয়া তাই অচল এখন,
ঝিঁঝি শুধু হয় না নিথর;
চামচের আলতো টানে সর
ইচ্ছে হলে তুলে নেওয়া যায়,
জখমের মামড়ি যেমন।
আগুন
আবছা আলোয় আমার মুখ
আড়াল চোখে সে-ই দেখেছে, জীনি।
এমন করে তাকায় যেন গোপন কী এক অভিপ্রায়
দৃষ্টিও সাবধানী।
চোখের আলো সেই কথাটা
নিবিড় করে জানিয়ে দিল আমায় জনান্তিকে-
তখন আমি মোহের আগুন
পান করেছি আমার মতো,
পরন্ত রাত্রিকে
বলছি- ওগো আমার তুমি
পান করো হে একচুমুকে
পাত্র করো খালি!
প্রলম্ব নীল শিখায় কেঁপে
মাথার ওপর রাত্রি রেখে
শূন্য বোতল জ্বালি।
আগুনরঙা করতলের একমুঠোতে এত আলোয়
স্পর্শ পেল তাপ;
ঠোঁটের ফাঁকে নীরবতা,
চোখের কোণে কী সেই কথা-
অন্তিমত নেই কোনো যার পাপ!
পবিত্র কী?
কে আর জানি!
হারাম শুধু উচ্চারণে ধার্য হয়ে যায়।
শৃঙ্খল সে এমন,
তবু আমার মাঝে নেশার আগুন
তন্ময়তা পায়।
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেলে
পলাশ-বিছোনো পথ,
চুম্বন-ডুবে-যাওয়া, গোধূলি সাক্ষী, হ্রদ,
এসব তো ছিলই, সঙ্গে নানা প্রিয় অনুষঙ্গ।
আত্মরতি,
আত্মহননব্রতী কবিতারা আমার-
সব পার হয়ে,
জমাট দেয়ালের সামনে, চমকে, দাঁড়ালে!
ও-পাশে কী আছে?
ধর্মের দোহাই বল, ও-পাশে কী আছে!
আছে, কথা-বলা মানুষের, গলা-টিপে-মেরে-ফেলা
শবদেহগুলি।
তারপর?
সে-ভাবনা, তোমার
পূর্ণিমা
পূর্ণিমার চাঁদ যেদিন ফুটে ওঠে, শহর বাতিগুলি নিভিয়ে দেয়।
জোনাকিপোকা, কোরা চাঁপাফুলের গায়ে টানা জরির মতো চমকে নেয়।
অঢেল ফুর্তির দেদার আয়োজন, আকাশ, তার নীচে বার-বি-কিউ,
গাছেরা জেগে বুঝি, বিরহ-পোড়া-আঁচে চাঁদও খুলে গেছে, রম্য ভিউ!
সুগন্ধের পাশে লজ্জা জড়োসড়ো, নতুন বৈশাখী, নব বাতাস,
জানে না গ্রহটিতে গ্রহণ লেগে গেছে, চোখে তো জুড়ে আছে ফুল রোম্যান্স।
তীব্র প্রেম আনে তীব্র অন্ধতা, ভুল মানুষগুলি জোছনাময়-
স্বার্থপর! তবু ভালো তো বেসেছিলি, সে-দোষেগুণে সব পাপক্ষয়।
পাশেই শালবন, রাগি নিসর্গটি পাতায় অপমান জুড়ে নিল,
টালমাটাল এই সময়, বমি করে, বমিতে বন্দুক ঝাপটাল।
স্বপ্ন/২
তুই জঙ্গলে চলি যা...
তুই সংসারে থাকি না...
এরপর, নাচ ঘুরে-ঘুরে!
নাচ থামলে পালাতে বললাম।
কিন্তু কী করে পারবি,
তোর পাঞ্জাবির সুতো উঠে
আমার কবজিতে,
লোহার মকরমুখে আটকে গেছে।
দাঁত দিয়ে কাটা যাচ্ছে না বলে
অসহায় চোখে চাইলি, আর,
কাঁচি আনতে ভেতরের ঘরে গেছি যেই,
রাত নেই, শ্বাস নেই,
সব ফরসা
প্রজন্ম - ২
মাটি নয়, সর্পগর্ত!
মাথা নীচু করেছ কী, দংশন!
হাত নয়, বিছুটিপত্র!
মৃদু ছুঁতে চেয়েছ তো, কী জ্বলন!
এইখানে আমার নিবাস।
এখানেই খসে নিঃশ্বাস।
সৌজন্য, অপার নরক!
ভয়-গোলা শিল্পচমক-
কালো, খুব কুচকুচে কালো ছাপিয়ে কে ফরসা নামালো!
কতদিন রঙে পা রাখিনি!
কতদিন রঙে পা রাখিনি!
তুই কি আমার শিশুমেয়ে,
জল ভেঙে পড়লি গড়িয়ে!তুই ত্রাণসামগ্রী, আর,
রাত-মোছা গন্ধ-রবার
জন্মের কথা
কোনও জন্মের কথাই তো যথার্থ লিখতে পারি না আমি।
পরীজন্ম, পেত্নিজন্ম, না শেয়ালজন্ম!
মন লেগেছিল না কোথাও।
আজও যে দেবযানে চড়ে ভেসে বেড়াচ্ছি, মেঘে ভিজে যাচ্ছি,
তল নেই, কূল নেই, চোখের জলটুকু পর্যন্ত নেই।
অমৃতময় এ-যাত্রা। অমৃতলোকের দিকে, বুঝি! তবু দেখ, আলগা-আলগা
শুধু নীচে তাকাতে যা ভয়!
দুঃখে বসে যাচ্ছে মাটি।
ফিকে তমসা পেরিয়ে গাঢ তসমার লেপ-
আমার দেখতে অবশ্য অসুবিধা হচ্ছে না,
ঝকঝক করে দুটো চোখ জ্বলছে, শরীর অপার।
কিন্তু সত্যি নীচে চাইতে পারছি না,
একটু কোমলের মধ্যে হাতছানি দিয়ে
কেউ ডাকলেই, টুপ করে খসে পড়ে
আবার মানুষজন্ম নিয়ে ফেলি যদি
রাহুল পুরকায়স্থ
বন্ধু
এক
নিরন্তর, অস্ত্রনীল, তুমি অন্ধকারে
তোমার ইশারা বুঝি কুসুমসম্ভবা
তোমার চোখের জল মুঝি অন্ধকারে
জিভ নড়ে, কাটা জিভ, রক্তমাখা থাবা
দুই
রক্ত ছোবলের, আমি তাকে চেতনাতে আনি
তোমার থাবার স্পর্শে কাঁপে অন্ধকার
কাঁপা, তুমি ছল বোঝো!
বোঝো মৃত্যু, বোঝো ভালোবাসা?
আমার অতীত জানে আমার এখন
তুমি জানো আত্মরতি যমের পিপাসা
তিন
পিপাসার্ত, তোমার তৃষ্ণার কাছে বসেছি এখন
বলেছিঃ পিপাসা দাও, দৃষ্টি দাও, ক্রূর বন্ধুতাও
তোমার চোখের জলে প্রেমিক ফুরালে
ভেবেছি আমার গৃহ পবনের নাও