রাঢ়-বাংলার কবিগান


বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় মিশ্ররীতির নাটকীয় লোকসঙ্গীত কবির লড়াই বা কবিগান। দুজন পাল্লাদার বা কবিয়ালের সক্রিয় অংশগ্রহণে মূলত রামায়ণ মহাভারত বিবিধ পুরাণ মঙ্গলকাব্য বা হিন্দু-মুসলমান শাস্ত্রের অন্তর্গত দুটি চরিত্রের উপস্থাপনায় নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জমে ওঠে কবির লড়াই বা পালাগান। বন্দনাগান ছড়া পাঁচালিগান পয়ারকাটা চুটকিগল্প আর বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে কবিগান প্রাণবন্ত। আর পাঁচটা লোকআঙ্গিক লুপ্ত বা বিলীয়মান হলেও কবিগান এখনও টিকে রয়েছে যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এ গান পুরোপুরি পেশানির্ভর। মা-মাটি-মানুষের গান। দর্শক বা শ্রোতারা হলেন গ্রামীণ খেটে খাওয়া আপামর হিন্দু-মুসলমান।
গ্রামবাংলা থেকে উদ্ভূত কবিগান একসময় বিশেষ করে অষ্টাদশ উনিশ শতকে নগর কলকাতার জমিদার ও বণিকমহলের খুবই আদৃত ছিল। রাতের মেহফিলে ঢোল-কাঁসি নিনাদিত আদিরসাত্মক আর উত্তেজক এই গানের লড়াই দারুণ জমে উঠেছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যুগ শুরু। কবিগান আবার যথারীতি গ্রামে ফিরে আসে। আজও রাঢ়-বাংলার গ্রামীণ মানুষের অন্যতম বিনোদন এই কবিগান।
কবিগানের উৎস-উদ্ভবকাল নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। কেউ বলেছেন কবিগানের জন্ম হয়েছে প্রাচীন যাত্রা থেকে। কারো মতে প্রাচীন ঝুমুরগান। কেউ বা বলেছেন প্রাচীন পাঞ্চালিকাসাহিত্য থেকে এই লোক-আঙ্গিকের উদ্ভব। কবিগান মানেই দুটিপক্ষের ঠোকাঠুকি। ঢোল-কাঁসি দোহারের সঙ্গতে বাঁধা আসরে দুই ওস্তাদের ছড়াকাটাকাটি এবং চাপান উতোর অর্থাৎ প্রশ্ন ও জবাবি গানের লড়াই।
রবীন্দ্রনাথ কবিসঙ্গীত প্রবন্ধে জানিয়েছেন- প্রথমে নিয়ম ছিল দুই প্রতিপক্ষ দল পূর্ব থেকে পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করে উত্তর-প্রত্যুত্তর লিখে আনতেন। পরবর্তীকালে আসর করে দুজন কবিয়াল পরস্পর বাগযুদ্ধে কবির লড়াই জমিয়ে দিতেন। তিনি লিখেছেন - "কথার কৌশল, অনুপ্রাসের ছটা, এবং উপস্থিত মতো জবাব ছিল কবিগানের মুখ্য আকর্ষণ।" হারজিত যতক্ষণ না নিষ্পন্ন হত ততক্ষণ চলত গানের লড়াই। এমনকি তিনরাত্রি পর্যন্ত গড়িয়ে যেত কবির লড়াই।
উনিশ শতকে কবিগানের বিষয়বস্তু বলতে গুরুদেবের গান অর্থাৎ বন্দনাংশ, সখিসংবাদ ও বিরহমূলক গান। এছাড়া যুক্ত হয়েছিল ভবানীবিষয়ক লহর ও খেউড় গান। কবিগানে পড়েছিল ক্রমশ মার্গসঙ্গীতের প্রভাব। গবেষকদের মতে পূর্ণাঙ্গ কবিগানের পালায় দশটি বিভাগ ছিল যথা - চিতেন পরচিতেন ফুকা মেলতা মহড়া শওয়ারি খাদ দ্বিতীয়মহড়া দ্বিতীয়ফুকা ও অন্তরা। কবিগান সম্পর্কে শিক্ষিতজনের প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দশজন কবিয়ালদের জীবনী ও ২৭০টি গান সংগ্রহ করেন। প্রথমযুগের কবিয়ালদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন গোঁজলা গুঁই হরু ঠাকুর রাসু নিত্যানন্দ দাস কেষ্টা মুচি এন্টনি ফিরিঙ্গি ভোলা ময়রা রাম বসু আকাবাঈ প্রমুখ।
বর্তমানে কবিগান পুরোপুরি মৌখিক। বিষয়বস্তুতে এসেছে পরিবর্তন। পুরাণ সাহিত্যের পাশাপাশি সামাজিক রাজনীতি ও ক্যারিকেচার পালার অন্যতম বিষয়বস্তু। কয়েকটি জনপ্রিয় পালা হল কৃষ্ণ-দুর্যোধন রাম-রাবণ কৃষ্ণ-গান্ধারী শাক্ত-বৈষ্ণব চাঁদ-মনসা বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণ সেকাল-একাল কংগ্রেস-সিপিএম হিন্দু-মুসলমান ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি। বর্তমানে আবার জনকল্যাণ মূলক সরকারি প্রকল্পের বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে কবিগান হচ্ছে যেমন কন্যাশ্রী ডেঙ্গু প্রতিরোধ সাক্ষরতা ইত্যাদি। তবে গ্রাম-বাঙলায় পেশাদারি কবিগান মেলা উৎসবে পুজো-আর্চায় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছানুসারে দিন বা রাতে মঞ্চস্থ হয়। গানের স্থায়িত্বকাল মোটামুটি পাঁচ থেকে ছয়ঘণ্টা। প্রতি দলে থাকেন একজন কবিয়াল ছাড়া দুজন দোহার ঢুলিদার। ইদানিং বাদ্যযন্ত্র হিসাবে হারমোনিয়াম ক্যাসিও ফুলোট বেহালাও ব্যবহৃত হচ্ছে। কবিয়ালের পোশাক সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। গলায় উত্তরীয়। দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য জেলার তুলনায় বর্ধমান বীরভূম নদিয়া বাঁকুড়া আর মুর্শিদাবাদ জেলার হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে প্রিয় বিনোদন এই কবিগান।

মুর্শিদাবাদ জেলার জনপ্রিয় কবিয়ালরা হলেন গুমানি লম্বোদর জানকি রায় কিশোরী কোঁড়া কাঞ্চন মণ্ডল প্রমুখ। বীরভূম জেলার অন্যতম কবিয়াল হলেন কেনারাম মোদক শিবশংকর পাল জ্ঞান সাহা। নদিয়াজেলার অন্যতম কবিয়াল হলেন নৈরুদ্দিউন গৌতম হাজরা হারাধন দে মুকুল ভট্টাচার্যরা। বর্ধমান জেলার কবিয়ালরা হলেন সাহেবজান চাঁদ মুহম্মদ মধুসূদন ঘোষাল সনৎ বিশ্বাস দিলীপ চ্যাটার্জি সুবিকাশ ব্যানার্জি সুভাষ মণ্ডল শুভাশিস ব্যানার্জি প্রমুখরা। বাঁকুড়ার জনপ্রিয় কবিয়াল গণেশ ভট্টাচার্য। দেশ বিদেশে সমানভাবে তিনি আদৃত। পূর্ববঙ্গের ঘরানার অন্যতম লব্ধ-প্রতিষ্ঠ কবিয়াল অসীম সরকার প্রভাত সরকার সজল সরকার আদিত্য সিংহরা।
বর্তমানে প্রথম পালায় বন্দনার পর সংক্ষেপে কবিগানের ইতিবৃত্ত আলোচনা করা হয়। এরপর শ্রোতারাই ঠিক করেন পালা নির্বাচনসহ কে কোন ভূমিকায় লড়াই করবেন। দুই কবিয়াল দুই দুই বা তিন তিন পালায় বিন্যস্ত করে পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি প্রতিযুক্তি তত্ত্ব সাজিয়ে নিজ নিজ চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন। এইভাবেই জমে ওঠে কবির লড়াই। ছড়া চুটকিগল্প ইত্যাদির পাশাপাশি হরতালি ও টপ্পা পাঁচালি কবিগানের মূল আকর্ষণ। শেষে আবার দুই কবিয়ালের মধ্যে বোল কাটাকাটি হয় যা খানিকটা তরজাগানের মতো। এটি মূলত সঙ্গীত-নাট্য। প্রচলিত বোলের পালাগুলি হলো বেদবতী-রাবণ ললিতা-কৃষ্ণ হরিশ্চন্দ্র-শৈব্যা কর্ণ-কুন্তী বিল্লমঙ্গল-চিন্তামণি ইত্যাদি।
(তথ্যঋণ - রাঢ়-বাংলার কবিগান,স্বপনকুমার ঠাকুর / ভিরাসত আর্ট পাব্লিকেশন)