কীর্তনের চিরায়ত সুরে খ্রিস্টের বন্দনা

নদিয়া জেলার কীর্তন খ্যাতি পেয়েছে সারা বিশ্বজুড়ে। চৈতন্যদেবের আপন দেশ বলে কথা! কৃষ্ণনামে মাতোয়ারা সংগীতপ্রেমী থেকে ভক্তজন। রাগরাগিনীর সাধনায় একাত্ম হয়ে গেছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন। এহেন জায়গাতেই কান পাতলে শোনা যায় অন্য আরেক ধরনের কীর্তন। তাতে নেই কৃষ্ণ-রাধার কাহিনী, নেই বৈষ্ণব সাধনার গূঢ় তত্ত্ব। তা বলে ভক্তিরসে ভাটা পড়েনি এতটুকুও। কীর্তনের চিরায়ত সুরে গাওয়া হচ্ছে খ্রিস্টের বন্দনা। বড়োদিনের সময় ভোরবেলা গ্রামের পথে পথে খোল, করতাল, হারমোনিয়াম, বাঁশি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন খ্রিস্টীয় কীর্তনীয়ার দল। দূর থেকে শুনলে মনে হবে অগ্রহায়নের সকালে তাঁরা হরিনাম করতেই বেরিয়েছেন। কিন্তু ভুল ভাঙবে কাছে গেলে। শোনা যাবে, “শুভদিন এলো রে, ভবে হল সুপ্রচার/ ঈশনন্দন যিশু ভবে হলেন অবতার”। বছরের অন্যান্য সময়েও স্থানীয় খ্রিস্টানদের জন্ম, বিয়ে অথবা মৃত্যু হলে তার স্মরণে যে প্রার্থনা হয়, তাতেও থাকে কীর্তন। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী পালটে যায় কথা আর সুর।
আরও পড়ুন: “বন্ধু তোর লাইগা রে আমার তনু জড়জড়...”
গত ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নদিয়ায় খ্রিস্টীয় কীর্তন ও পালাগানের চর্চা হয়ে আসছে। এমনকি নদিয়ার বাইরেও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বাংলাদেশের মেহেরপুর, কুষ্টিয়ার মতো জায়গাতেও এই কীর্তন শুনতে পাওয়া যায়। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, নদিয়াতে এখন যাঁরা খ্রিস্টীয় কীর্তন গেয়ে বেড়ান, একসময় তাঁদের পূর্বসূরীরা বৈষ্ণব কীর্তন গাইতেন। পরবর্তীকালে সেই সব মানুষ যখন খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হলেন, কীর্তনের মাধ্যমেই তাঁরা করতে লাগলেন যিশুর ভজনা। এইভাবেই উদ্ভব হল খ্রিস্টীয় কীর্তনের। আবার কেউ কেউ মনে করেন, কালীকীর্তনের অনুসরণে খ্রিস্টীয় কীর্তন শুরু হয় প্রায় ১৫০ বছর আগে। আরেকটি প্রচলিত মত হল, সাধারণ বাঙালি খ্রিস্টানরা সাহেবদের গাওয়া যিশুবন্দনা ঠিকঠাক বুঝতে পারতেন না। তাই স্থানীয় বৈষ্ণব কীর্তনের সুরেই তাঁরা খ্রিস্টের ভজনা শুরু করেন। জানা যায়, রেভারেন্ড মতিলাল মল্লিক নামের এক বাঙালি পাদ্রি আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগে বৈষ্ণব পালাগানকে ভালোবেসে নবদ্বীপের টোল থেকে কীর্তন শিখেন। তারপর সেই সুরেই যিশুভক্তির কথা বসিয়ে ছড়িয়ে দেন তিনি। এখন বাঙালি খ্রিস্টানদের মধ্যে কীর্তনের আঙ্গিকে বড়োদিনের ক্যারল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ছবি সূত্র – ডন বস্কো প্যারিশ, কল্যাণী
নদিয়া জেলার রানাঘাট, চাপড়া, পুঁটিমারি কিংবা মালিয়াপোঁতার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে খ্রিস্টীয় কীর্তনের জন্য। এই সব জায়গায় খ্রিস্টীয় পালাগানের আলাদা আলাদা দল রয়েছে। সারা বছরই তাঁরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কীর্তন গেয়ে বেড়ান। বাসু মণ্ডল, স্যামুয়েল মণ্ডল, হারান মাকাল এই গানের হিট শিল্পীদের কয়েকজন। এই কীর্তনীয়ারা প্রায় সবাই নানা ধরনের পেশার সঙ্গে যুক্ত। তার মধ্যেই এঁরা দল নিয়ে মহড়া দেন নিয়মিত। ডাক পেলেই গাইতে চলে যান পালাগানের আসরে। বৈষ্ণব পালাগানের মতো এই পালাগানেও মোটামুটি তিন ঘণ্টা সময় লাগে। শ্রোতাদের অনুরোধ বিশেষ গুরুত্ব পায় পালাগানের অনুষ্ঠানে। কখনও সংকীর্তনের ধাঁচে দুঅক্ষরের ‘যিশু’ শব্দটাকেই বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাওয়া হয়। কখনও ‘জোসেফের পালা’, ‘যিশুর দীক্ষা’ গেয়ে শোনান কীর্তনীয়ারা। এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমকালীন নানা ধরনের বাংলা গানের সুর ব্যবহার করেও খ্রিস্টান ধর্মসংগীত গাওয়া হচ্ছে ঠিকই, তা বলে কিন্তু খ্রিস্টীয় কীর্তনের জনপ্রিয়তা একদমই কমেনি।