নো চোরা ঢেকুর : খাইবার পাসের এটাই ইউএসপি

আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, ওই সময় দোকানের খাবারে লাঞ্চ বা ডিনার সারতে বাঙালি মধ্যবিত্ত খুব একটা অভ্যস্ত ছিল না। পাড়ায় পাড়ায় বিরিয়ানির দোকান কল্পনাই করা যেত না তখন। অফিসের টিফিনে বাড়ি থেকে খাবার নেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। এখন দিন পাল্টেছে। অফিসের টিফিন বাক্সটা আজকাল বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অপ্রয়োজনীয় বোঝা মনে হয়। সন্ধে গড়াতে না গড়াতেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিরিয়ানি-চাউমিন-মোগলাই পরোটার দোকানগুলোর সামনে দেখা যায় বিশাল লাইন। এর সঙ্গে মাল্টিকুইজিন রেস্তোরাঁগুলোও আর আগের মতো ব্রাত্য নেই। কিছুদিন পরপরই বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, ভাই, বোন কিংবা বন্ধুদের নিয়ে ট্রিট দেওয়া এখন বাঙালির কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এ তো গেল কলকাতা শহর এবং তার আশেপাশের গল্প। মফস্সলের কাহিনি একটু হলেও আলাদা। সেখানে মানসিকতায় ঢুকে গেছে বিশ্বায়ন, কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্যে অনেক কিছুই কুলোয় না। ভালো মাল্টিকুইজিন রেস্তোরাঁর অভাব বোধ করেন অনেকেই। অভাব থাকলেও উন্নত গুণমানের রেস্তোরাঁ যে একেবারেই নেই, তা কিন্তু নয়।
মফস্সলের রসনা এবং মর্যাদাকে সুবিচার করে যেসব রেস্তোরাঁ খাদ্যরসিক বাঙালির মন জয় করে নিয়েছে, তাদের মধ্যে ভদ্রেশ্বরের ‘খাইবার পাস’ প্রথম সারিতেই থাকবে। এখন কলকাতায় এই নামেরই বেশ কয়েকটা রেস্তোরাঁ আছে ঠিকই, তবে এগুলোর সঙ্গে ভদ্রেশ্বরের দোকানটির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। গঙ্গার তীরে ঐতিহ্যবাহী জনপদ ভদ্রেশ্বর, তার ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যাবে ইউরোপিয়ান বণিকদের মানদণ্ডকে রাজদণ্ডে পরিণত করার প্রতিযোগিতা। পাওয়া যাবে প্রাচীন শিব মন্দিরকে ঘিরে ভক্তজনের কতই না কল্পকথা। খাবারদাবারে কলকাতার ফ্লেভার আনার জন্যই চার বন্ধু ঠিক করেছিলেন একটি নতুন রেস্তোরাঁ খুলবেন এই শহরে। সঞ্জয় চক্রবর্তী, সমীর চক্রবর্তী, সুবীর চক্রবর্তী এবং অনুপম দাশগুপ্ত এঁরা কেউই শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের কথা ভেবে নতুন রেস্তোরাঁ তৈরির সিদ্ধান্ত নেনই। ব্রেড অ্যান্ড বাটারের অভাব এঁদের নেই, নেহাৎ খেতে ভালোবাসেন বলেই শখের খেয়ালে এই রেস্তোরাঁ তৈরি করার চিন্তা তাঁদের মাথায় এসেছিল।
আরও পড়ুন
গরম ভাতের খিদে এবং সাধুদার হোটেল...
২০১৩ সালের মহালয়ার দিন থেকে ‘খাইবার পাস’ তার যাত্রা শুরু করে। স্পিন গার পর্বতের উত্তরভাগকে ছেদ করে পাকিস্তান আর আফগানিস্থানকে যুক্ত করেছে খ্রিস্টপূর্ব যুগের রাস্তা খাইবার পাস। দারায়ুস থেকে আলেকজান্ডার, মহম্মদ ঘুরি থেকে চেঙ্গিস খান – এই গিরিপথের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কতই না স্মৃতি। ভদ্রেশ্বরের প্রথম মাল্টিকুইজিন রেস্তোরাঁর যখন নাম রাখা হল এই গিরিপথের নামে, তখন ইংরেজি বানানটা একটু পালটে দেওয়া হল। Khyber Pass-কে করা হল Khaibar Pass, বাঙালিয়ানার সঙ্গে সাজুয্য রেখেই। এর আগে ভদ্রেশ্বরে খাবারের দোকান বলতে ছিল পাইস হোটেল। এখন জনবহুল মোড়গুলো কিছু এগরোল-চাউমিনের দোকান তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দাম মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে রেখে খাবারের গুণগত মানের দিক থেকে ‘খাইবার পাস’ সেখানে এখনও সেরা। ভদ্রেশ্বরের অন্য যে কোনো দোকানে যখন ফিস ফ্রাই ১০০ টাকায় পাওয়া যায়, তখন খাইবার পাসে সেটা মেলে ৭০ টাকাতেই। এখানে খাওয়ার পর চোরা ঢেকুর উঠেছে বলে কোনো অভিযোগও পাওয়া যায়নি আশেপাশের মানুষজনের থেকে।
গত কয়েক বছরে খাইবার পাসে আইটেম অনেক বেড়েছে। ইন্ডিয়ান, তন্দুর, চাইনিজ – তিন ধরনের খাবারই এখানে পাওয়া যায়। তবে এখানকার সবথেকে বিখ্যাত খাবারগুলো হচ্ছে স্টার্টার, কুলচা আর খাইবার পাস স্পেশাল মাটন। এর পাশাপাশি খাইবার পাস স্পেশাল সুপ, মকটেলস, ভেটকি তন্দুরি, মুর্গ মুসল্লমও স্থানীয় মানুষের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। ভদ্রেশ্বরে সাধারণত বাইরের লোকজনের যাতায়াত কম, তাই কলকাতার মতো ভিড় এই রেস্তোরাঁয় সারাবছর হয় না, নিয়মিত ক্রেতা এখানে সীমিত। তবে দুর্গাপুজো আর জগদ্ধাত্রী পুজোয় মরসুমটা ব্যতিক্রম। এই দুটো সময় খাইবার ভরে ওঠে প্রচুর ভোজনবিলাসী মানুষের আনাগোনায়। খাইবার পাসের অন্যতম মালিক অনুপম দাশগুপ্ত ‘বঙ্গদর্শন’-কে জানালেন, “খেতে হলে ভালো কোয়ালিটির খাবার খান। আমি এই বার্তাই আপনাদের মাধ্যমে আমবাঙালির কাছে পৌঁছে দিতে চাই”।