বাঁশদ্রোণীর খানপুর গার্লস হাইস্কুল : বাস্তুহারা, কলোনি-অঞ্চলে নারীশিক্ষার দিশারী

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় গড়ে ওঠা কলোনিগুলোতে যে সব স্কুল কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে দক্ষিণ কলকাতার বাঁশদ্রোণীর খানপুর গার্লস হাইস্কুল অন্যতম। বাঁশদ্রোণী অঞ্চলের শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে স্বর্গীয় হীরেন্দ্র লাল সরকার (অঞ্চলে যিনি এইচ এল সরকার নামে পরিচিত) নিজস্ব জমি দান করেন। সেই জমিতেই ১৯৩৬ সালে খানপুর স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়। তখন এই স্কুল ছিল কো-এড। পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মেয়েদের আলাদা বিভাগ তৈরি হয়, যা আজ খানপুর গার্লস হাইস্কুল নামে পরিচিত।
এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন শ্রীমতি আশা দাশগুপ্ত। পরবর্তীকালে শ্রীমতি আরতি বোস এবং স্নিগ্ধা মজুমদার যথাক্রমে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। খানপুর গার্লস হাই স্কুলে বর্তমানে প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে কর্মরত ডঃ কেয়া চট্টোপাধ্যায়। স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি হিসাবে স্বর্গীয় হীরেন্দ্রলাল সরকারের পর যথাক্রমে তাঁর স্বর্গীয় পুত্র ওঙ্কারলাল সরকার এবং দৌহিত্র ডঃ প্রসেনজিৎ সরকার আসীন ছিলেন। বর্তমান সভাপতি শ্রীমতি সুপর্ণা চক্রবর্তী (এসআই অফ্ স্কুলস)।
এই বিদ্যালয় ১৯৫৬ সালে বোর্ডের অনুমোদন সাপেক্ষে জুনিয়র হাই স্কুল থেকে হাইস্কুলে উন্নীত হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে ২০০০ সাল থেকে স্কুলে আর্টস সায়েন্স ও কমার্স এই তিনটি বিষয়ই উচ্চমাধ্যমিকে পড়ানো হয়। এই তথ্য জানালেন স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা ডঃ কেয়া চট্টোপাধ্যায়।
স্কুল ভবনটি বর্তমানে দুটি ব্লকে বিভক্ত। একটি ব্লক ৫ তলা, অন্যটি ৪ তলা। শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা ২৮টি। ২ টো হল আছে। বর্তমান ছাত্রী সংখ্যা ১৩২০ জন। স্থায়ী শিক্ষিকা ২৭ জন। প্যারা টিচার ২ জন। অ্যাপ্রুভড কন্ট্রাকচুয়াল শিক্ষিকা ২ জন। অশিক্ষক অর্থাৎ গ্রুপ ডি কর্মচারী ২ জন।
সাধারণ সেকশনে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শারীরশিক্ষা ও সংস্কৃত ছাড়া অন্তত একজন একজন করে হলেও মোটামুটি সব বিষয়ের শিক্ষিকা আছেন। যদিও শূন্যপদও আছে। হায়ার সেকেন্ডারি সেকশনে সব বিষয়ে শিক্ষিকা নেই। সাধারণ সেকশনের শিক্ষিকারাই হায়ার সেকেন্ডারি সেকশনে পড়ান। তবে কিছু বিষয়ভিত্তিক শিক্ষিকা আছেন। স্কুলে অনুমোদিত শিক্ষিকার সংখ্যা ৩২ হলেও এই মুহূর্তে ২৭ জন স্যাংশনড শিক্ষিকা স্কুলে কর্মরত।
উচ্চমাধ্যমিকে আর্টস, কমার্স ও সায়েন্স তিনটি সেকশনই আছে। অংক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, কম্পিউটার সায়েন্স, কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন, ভূগোল,অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অ্যাকাউন্ট্যান্সি, বিজনেস স্টাডিজ প্রভৃতি বিষয় এই স্কুলে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়ান হয়।
স্কুলে ৫টি ল্যাবরেটরি আছে। লাইব্রেরি আছে। তবে স্মার্ট ক্লাসরুম নেই। সোলার পাওয়ার জেনারেশনের ব্যবস্থা আছে, রয়েছে সোলার পাওয়ার গ্রিডের ব্যবস্থাও। স্কুলে খেলার মাঠ রয়েছে।
স্কুলের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল উল্লেখযোগ্য হয়। ২০২২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় খানপুর গার্লস হাইস্কুলে সর্বোচ্চ নম্বর ওঠে ৯৩% এবং ২০২৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর ওঠে ৯৪%। মাধ্যমিকে সাফল্যের হার ৯৯%। ২০২২ সালে উচ্চমাধ্যমিকে সর্বোচ্চ নম্বর ওঠে ৯৩% এবং ২০২৩ সালে উচ্চমাধ্যমিকে সর্বোচ্চ নম্বর ওঠে ৯২%। উচ্চমাধ্যমিকে সাফল্যের হার ৯৮%। ধারাবাহিক ভাবে দীর্ঘকাল ধরে ভালো হয়ে আসছে এবং এখনও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ভালো হচ্ছে।
খানপুর গার্লস হাইস্কুলে স্বচ্ছল পরিবারের ছাত্রীদের সংখ্যা কম, অধিকাংশই আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের। আনুমানিক ৭ থেকে ৮% প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া এই স্কুলে পড়তে আসে।
স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি কর্মশিক্ষার অন্তর্গত বিভিন্ন হাতের কাজ শেখান হয়। আনন্দ পরিসরে জীবনশৈলীর পাঠ দেওয়া হয়। এছাড়া সংগীতশিক্ষার ব্যবস্থা আছে।
স্কুলে প্রতি বছর স্পোর্টস হয়। স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস ছাড়াও ২৩ জানুয়ারি, ২৬ জানুয়ারি, ১৫ অগাস্ট, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিন উদযাপিত হয়। আগে স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী হত, এখন গরমের ছুটির মধ্যে ওই দিনটা ঢুকে পড়েছে, তাই রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন হয় না। পুজোর ছুটির আগে শারদোৎসব হয়।
করোনার সময়, লকডাউনের ফলে স্কুলের স্বাভাবিক পঠনপাঠন আর পাঁচটা স্কুলের মতোই থমকে যায়। তবে অনলাইন ক্লাস হয়েছে। সেই সময় সব পরীক্ষা অনলাইনেই হয়েছিল।
সার্বিকভাবে রাজ্যের হাতেগোনা কয়েকটি বাংলা মাধ্যম স্কুল বাদ দিলে প্রায় বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, লেখাপড়ার প্রচলন আছে, তেমন বাড়ির ছেলে-মেয়েদের পরিবারের অভিভাবকরা স্থানীয় বাংলা মাধ্যম স্কুলে না পড়িয়ে বাড়ি থেকে দূরবর্তী বা বাড়ি সংলগ্ন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন। এই প্রবণতা বাড়ছে। অন্যদিকে স্কুলে পর্যাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী থেকেও বহু বাংলা মাধ্যম স্কুলে পরিকাঠামো থেকেও শিক্ষক-শিক্ষিকা সঠিক সংখ্যায় নেই। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাওয়ার পিছনে একদিকে অভিভাবকদের তাঁদের সন্তানদের বাংলা মাধ্যমে পড়ানোর অনীহা অন্যদিকে প্রকৃত ও উপযুক্ত সংখ্যায় শিক্ষক-শিক্ষিকা না থাকা অন্যতম কারণ। তবে এর মধ্যেও ছাত্রীদের সঠিকভাবে পড়িয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা উল্লেখযোগ্য ফল করছে খানপুর গার্লস হাইস্কুল। স্কুলের পঠনপাঠন, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে কোনও প্রভাব সেই অর্থে পড়তে দেননি স্কুলের বর্তমান ২৭ জন স্থায়ী শিক্ষিকা, ২ জন প্যারা টিচার, ২ জন অ্যাপ্রুভড কন্ট্রাকচুয়াল শিক্ষিকা। উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগে সব বিষয়ের শিক্ষিকা না থাকা স্বত্ত্বেও সেই ঘাটতির ছাপ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে বিন্দুমাত্র প্রতিফলিত হতে দেননি স্কুলের শিক্ষিকারা। সমাজের জন্য উপযুক্ত ও মানানসই একটি প্রজন্ম তৈরি করে দেওয়া, যাঁরা আগামী দিনে সমাজের বিভিন্নক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবেন, সেই লক্ষ্যে খানপুর গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষাকারা অবিচল। এই মানসিকতা এখনও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে আছে বলেই, এখনও বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো টিকে আছে।
তবে বর্তমান রাজ্য সরকার ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য কন্যাশ্রীর মতো বৃত্তি চালু করায় আর্থিকভাবে, শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া পরিবারের মেয়েরা এখন স্কুলে আসছে। এছাড়াও পড়ুয়াদের সাইকেল, পোশাক, জুতো সরকার থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা, মিড ডে মিল ইত্যাদি সরকারি শিক্ষা সহায়ক প্রকল্প রাজ্যে চালু হওয়ায় বাংলা মাধ্যম স্কুলে শহর, শহরতলী এলাকা ছাড়া গ্রামীণ এলাকায় স্কুলে মেয়েদের অর্থাৎ ছাত্রীদের অংশগ্রহণ যে বেড়েছে সেটা অনস্বীকার্য। তবে পরিকাঠামো থাকার পরেও শুধুমাত্র শিক্ষক-শিক্ষিকার অপ্রতুলতায় কলকাতা ও রাজ্যের বিভিন্ন শহুরে বাংলা মাধ্যম স্কুলের অবস্থা ভালো যে নয়৷ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথ্যসূত্র : ডঃ কেয়া চট্টোপাধ্যায়, প্রধান শিক্ষিকা, খানপুর গার্লস হাইস্কুল
স্থানীয় বাসিন্দা ও স্কুলের অভিভাবক
ছবি: সংগৃহীত
*কলকাতা, শহরতলি বা জেলার কোনও না কোনও স্কুলের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে গর্বের ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বুনিয়াদি গল্প। এবার সেদিকেই ফিরে তাকিয়ে চলছে নতুন ধারাবাহিক ‘আমাদের ইস্কুল’। সমস্ত পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। চোখ রাখুন প্রতি বুধবার সন্ধে ৬টায়, শুধুমাত্র বঙ্গদর্শনে।