No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    কেন্দুলির মেলা : লিয়াকতের পঞ্চাশে অনুপস্হিত তারক

    কেন্দুলির মেলা : লিয়াকতের পঞ্চাশে অনুপস্হিত তারক

    Story image

    "শোনো ভাই, মানুষ আনন্দ করবেই। দুর্ভিক্ষ হোক, অনাহার পেরিয়ে আসা হোক, ব্যক্তি বা সমাজের শোক হোক, শেষমেষ আনন্দে তার বিসর্জন। সেই মুহূর্তে নতুন শোক-দুঃখ-বিষাদ-উচ্ছ্বাস বা চাওয়া-পাওয়ার নয়া চলন শুরু। মেলা মানে এমন কিছুই।" - কেন্দুলির ঘাটে দাঁড়িয়ে অজয়ের বুকে অগুন্তি আখড়ায় চোখ বোলাতে বোলাতে বলেছিলেন লিয়াকতদা।

    বাঁদিক থেকে - লিয়াকত আলি, তারক দাস বাউল

    লিয়াকত আলি। কবি, প্রাবন্ধিক, শেষ পরিচয় পদকর্তা। মুখোমুখি এত বিশেষণ উচ্চারণ করলে প্রথমে লাজুক হতেন। তারপর রেগে যেতেন। প্রয়োজনে স্হান বদল। স্কুলের দিনগুলি পার করে জেল যাত্রায় নকশালজীবনের ইতি। জেলার আয়ান রশিদ খানের দেখানো পথে কলেজ পার করে কলকাতায় বিড়লার ম্যানেজমেন্ট স্কুলে পাঠ। শিক্ষান্তে চাকরি। অতঃপর 'সাজানো জগৎ' থেকে পলায়ন? - তারপর কোথায় গেলে লিয়াকতদা? বোঝা গেল - প্রশ্ন পছন্দ নয়। তবে উত্তর এল। - "এই মনে করো - জান্নাতে বা জাহান্নামে একই সঙ্গে! অজয়ের পারে। এই গেরুয়া অজয় আমায় খেল। এখানেই মরবো। এখানেই।"

    এ সংলাপের আগে ও পরে অনেক বিলাপ। ভোরে, ভর সন্ধ্যা বা মধ্যরাতে অজস্র প্রলাপ। তাতে রং ভাসে। রং গাঢ় হয়, হালকা হয়। সে রং গেরুয়া। লিয়াকতের অজয় নদের বালুয়াড়ির রং।

    পশ্চিমের মালভূমি থেকে পাথর দুমড়েমুচড়ে কেন্দুলির ঘাটে জড়ো করে অজয়। প্রতিটি দানার রং তাঁর চেনা। অজয়ের উপত্যকার দু’পারের বিভিন্ন মহল্লার ধুলোবালিতে বুঁদ লিয়াকত পক্ষ নিতেন বালির। এ বালি মাটি হয়। ক্রমে ক্ষুদ্র হতে হতে তাতে মেশে আরো কত কি!

    একবার এক শহুরে দম্পতি সন্তান নিয়ে অজয়ের দক্ষিণ পারের এক আখড়ায় এলেন ছুটি কাটাতে। সহসা শিশুমন বালিতে গড়াগড়ি খেলে শহুরে মা বকে ওঠেন। - ‘ময়লা’ ঘাটা নৈব নেব চ। চোখ পড়তেই হেসে গড়াগড়ি যান ষাট পার করা লিয়াকত। "ময়লা কোথায়, এতো ধুলো, এতো বালি!" তারপর নিজেই গড়িয়ে নিলেন সহসা।

    এই উপত্যকায় ধীরেধীরে লিয়াকতের ফকির হয়ে ওঠা। দারিদ্র হোক বা ব্যক্তিগত শোকতাপ - লিয়াকতের সবই জমা আছে অজয়ের কাছে। জীবন চষে জমানো নুড়িপাথর বা তাঁর ধনসকল, সে সব সহজধারার অমূল্য সম্পদ। দেহতত্ত্বের জটিল পথে পরিক্রমা করে -  নতুন গানে কান রেখে শেষের দিকে উতলা হতেন - "নতুন পদ কোথায়।" বাউল-ফকিরদের তত্ত্বকথা শোনাতে শোনাতে যা কিছু লিখতেন, একদিন ফকিরডাঙার আখড়ায় তাতে সুর দিলেন অনুজ রাজা সিনহা। লিয়াকত নিলেন নতুন নাম - লিয়া। বাঁধতে শুরু করলেন গান। গত ৪-৫ বছরে রাজা সিনহা হয়ে সে গান গাইতে শুরু করেছিলেন তমালতলার তারক দাস আর লক্ষণ দাস। জটিল ভাবনা গানে গানে সহজ হবে তবে!

    আগামী ১৫ জানুয়ারি, পয়লা মাঘ, কেন্দুলিঘাটের ভক্তিভবনে পূর্ব নির্ধারিত দিনে লিয়াকত আলির মানপত্র পাঠ করবেন কেউ। তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিমুখ খুলে উদাস হবেন পরিচিত অজয়ের আত্মীয়রা। তাঁর ছবি, বিশেষ কাজকর্ম স্হান পাবে ভবনের সংগ্রহশালায়। লিয়াকত থাকবেন না। কারণ, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাঝে ১২ নভেম্বর হঠাৎই অসুস্হ হয়ে সিউড়ি হাসপাতালে পাকাপাকি বিদায় নিয়েছেন তিনি।

    হাজারো মাইকের ভিড়ে, আসল আর নকল বাউলের ভিড়ে জয়দেবের মেলায় মহাজনী পদ আর ভাবে সুর পাওয়া দুষ্কর। লিয়াকতের সম্বর্ধনায় তারক দাস বাউলের গান গাওয়ার কথা ছিল। না, তিনিও এবার থেকে কেন্দুলির ঘাটে পাকাপাকি স্বশরীর অনুপস্হিত। লিয়াকত আলির প্রয়াণের একমাস আগে আচমকা অসুস্হ হয়ে ১০ অক্টোবর প্রয়াত হয়েছেন তিনি।

    তারক দাস বাউল। কেন্দুলি গ্রামের ভূমিপুত্র। ঘনঘন অভিমান করতেন, উদাস হতেন। বাড়িতে, জয়দেবের মোড়ে, চেনা-অচেনা আখড়ায় দেখা না মিললে, পরিচিতরা দেখিয়ে দিতেন অজয়ের পথ। তারপর দু'পাশে পা চালিয়ে ডাকাডাকি করলে অজয়ের বালিয়াড়ি থেকে আসত পাল্টা উত্তর। এখানকার শৈশব, যৌবন পার করে - যে বয়সে শিল্পী তাঁর ভাবে ও ব্যাখ্যায় শ্রেষ্ঠত্বে পৌঁছতে শুরু করে, তারকদা সেখানে সাতান্ন'য় থামলেন আচমকা। মেলার দিনগুলিতে কেন্দুলির ঘাটের ডানদিকে তাঁর আখড়া। তার পাশে ভক্তিভবন। গত প্রায় দেড়-দু'দশক, তারক দাস বাউলই ছিলেন জয়দেব কেন্দুলির প্রথম প্রতিনিধি। অভিমানী, উদাসী, রসিক তারক দাসের স্বাভাবিক কথাবার্তায় থাকত কেন্দুলি গাঁয়ের উচ্চারণ। সম্ভবত বীরভূমের অন্যতম আর কেন্দুলির এই সময়কালের শ্রেষ্ঠ বাউলকে ছাড়াই শুরু হবে এবারের জয়দেব মেলা। তারক দাসের আখড়াও গানে ভরে উঠবে। আর সে আখড়ায় আপ্যায়ন করবেন তাঁরই দুই বাউল সন্তান সাধু ও ফকির।

    কলকাতায় উত্তাপ কমছে। এখানকার তাপমাত্রা থেকে সটান ৫ ডিগ্রি বাদ দিলে জয়দেব কেন্দুলির তাপমাত্রা। পৌষের সংক্রান্তি আর পয়লা মাঘের শীত সামলে - দিনের বেলায় অজয়ের বালিয়াড়িতে গজানো আখড়ার কলতান চিলচিৎকারে ছড়িয়ে দেবে অজস্র মাইক। গত দশ-বারোদিনে তার সিংহভাগ প্রস্তুতি সারা। মেলার দিনে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গভীর হবে। তমালতলায় সুধীর দাসের আখড়ায় লক্ষণদাসের দোতারায় গলা মেলাবেন শ্রেষ্ঠরা। রাত যত গভীর হবে পশ্চিমে তমালতলা থেকে পূবে মনের মানুষ আখড়ায় গান খোঁজার ফাঁকে একটু গরমের আশ্রয় চাইবেন নাম না জানা গাঁ-গঞ্জের মানুষ। বিকিকিনি শেষে এরপর ফিরেও যাবেন মেলার লোকজন। আর তখন কেন্দুলির সাকিনে চিরশায়িত তারক দাস, ২০ কিমি দূরে ফকিরডাঙায় শায়িত লিয়াকত আলির কবরে নিয়ম মেনে না মেনে গান ধরবেন - বন্ধুরা। বছরের বাকিটা সময়, চরম গরমে - বর্ষার প্রবল বন্যায় - শরতের কাশের আবেশে যারা জয়দেব বা কেন্দুলি পথ ধরেন - তাঁরা জানেন - গানে-কথায় -খেয়ালে-বেখেয়ালে অজয়ের বালিতে মিশে গেছেন তারক দাস আর লিয়াকত আলি। স্রেফ পাগল হলেই নাকি মানুষ এখানে হয়ে যায়। "বালি ময়লা নয়। প্রয়োজনে ময়লা ঢাকে, ঝেড়ে ফেলে জঞ্জাল।"- বলতেন লিয়াকত আলি। আর বালিতেই অবাধ্য হতেন বাউল তারক। গ্রীষ্মের রাতে আর শীতের দুপুরে যেখানে সেরে নিতেন ঘুম। এ বালি গেরুয়া। এ গেরুয়া পতাকা নয়, খতম-বিভাজন নয়, জাতপাত নয়, প্রতিষ্ঠান নয় - স্রেফ মানুষে মানুষ মেলানোর আস্কারা। বাকি কথা সব জানে অজয়ের গেরুয়া বালিয়াড়ি।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @