No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ‘রবীন্দ্র-রাজার চিঠি’ পেয়ে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন জাপানি ‘অমল’ আজুমা

    ‘রবীন্দ্র-রাজার চিঠি’ পেয়ে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন জাপানি ‘অমল’ আজুমা

    Story image

    “এত রক্ত কেন?”
    অপর্ণার হাহাকার তখন গোটা বিশ্ববাসীর প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর মিলছে না। যুদ্ধের নিয়ম তো এমনই। হ্যারি ট্রুম্যানের নির্দেশে বোমা পড়ল জাপানে। ‘ফ্যাট ম্যান’। শান্ত ছবির মতো শহর হিরোশিমা, কয়েক মুহূর্তে বালি পাথরের স্তূপ। হাজার হাজার মানুষের হাহাকারে ভরে যায় চারদিক। যুদ্ধ এতটাই নিষ্ঠুর! ধ্বংসস্তূপ সরাতে সরাতে ভাবছিল কিশোর। ওর পিঠের ঝোলায় একটা বাংলা বই। বইটার নাম ‘ডাকঘর’। 

    সেদিনের সেই কিশোর কাজুও আজুমা, শেষজীবন পর্যন্ত নিজেকে ‘অমল’ ভেবেছেন। খুঁজেছেন রাজাকে। তাঁর ‘রাজা’ রবীন্দ্রনাথ।  

    টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন পেয়েছিলেন তাঁর দুই শিক্ষাগুরু, বিশ্বখ্যাত জাপানি ভারততত্ত্ববিদ ডঃ হাজিমে নাকামুরা আর বহুভাষাবিদ, রবীন্দ্রসাহিত্যের বিশিষ্ট প্রবীণ অনুবাদক অধ্যাপক ডঃ শোওকো ওয়াতানাবেকে। মূল বাংলা ভাষা থেকে জাপানিতে ‘গীতাঞ্জলি’ প্রথম অনুবাদ করেছিলেন ডঃ ওয়াতানাবে। কিশোর কাজুও-র বাংলা ‘অ আ ক খ’ র পাঠ এঁদের হাত ধরেই। 

    ১৯৬৭-তে আজুমা স্নাতক হলেন জার্মান ভাষা নিয়ে। জার্মান শিক্ষার মূলেও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রভাবেই কবি গ্যেটের রচনা পড়তে আরম্ভ করেন আজুমা। তিনি যখন য়োকোহামা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক, ডাক এল বিশ্বভারতী থেকে। ‘রাজার চিঠি’ পেয়েই জাপানি ‘অমল’ সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিল শান্তিনিকেতন। 

    ১৯৭১ এ দেশে ফিরতেই হলো তাঁকে।  মন চায়নি যদিও। দুই বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। কুণ্ঠাহীনভাবে হাটুরে মানুষের সঙ্গে ভাব জমিয়েছেন। রপ্ত করেছিলেন উপভাষার খুঁটিনাটি, দেশীয় বুলিও। আজুমার বাংলা গদ্য পড়লে তাই চমকে উঠতে হয়। এমন সুন্দর ঝরঝরে বাংলা গদ্য আর কোনো জাপানি লিখতে পেরেছেন বলে জানা নেই। অনেক বাঙালিও হয়তো পারেননি।

    জাপানে ফিরেই গঠন করেছিলেন ‘জাপান টেগোর সমিতি’। সভাপতি, রবীন্দ্রসুহৃদ অধ্যাপক ৎসুশোও বিয়োদোও, গুরুদেবের জাপান সফরের দোভাষী, স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক নারীমুক্তি আন্দোলনের নেত্রী মাদাম তোমি কোরা।  তিনি নিয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদকের ভার। সংগঠনের উদ্দেশ্য, গুরুদেবের মৈত্রীর বাণী ছড়িয়ে দেওয়া যুদ্ধবিদ্ধস্ত জাপানে। ১৯৭১ দ্বিতীয় দেশভাগের সময়, ছিন্নমূল বাঙালির জন্য রাস্তায় নেমে ত্রাণ তুলেছিলেন আজুমা। সেই টাকা পৌঁছেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। ৭৩-এ জাপান সফরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজুমা ছিলেন তাঁর দোভাষী। সর্বক্ষণের সঙ্গী ও বিশ্বস্ত বন্ধু। উল্লেখ্য, যে স্বাধীন বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি যে দেশ দিয়েছিল, তার নাম জাপান।

    জীবনের চল্লিশ বছর কাজুও আজুমা কাটিয়েছিলেন দুই বাংলার গ্রামে ও বিভিন্ন শহরে। তাঁর হৃদয়ের বেশিরভাগটা জুড়েই আছে গুরুদেবের ইস্কুল। 

    ১৯৯৪ সালে গুরুদেবের টানে ফিরে আসা শান্তিনিকেতনে। প্রতিষ্ঠা হলো ‘নিপ্পন ভবন’। কলকাতার সল্টলেকের কাছে অবন ঠাকুরের পরম মিত্র প্রাচ্যবিদ কাকুজো ওকাকুরার স্মরণে গড়লেন ‘রবীন্দ্র-ওকাকুরা-ভবন’। মূলত আজুমার উদ্যোগেই ১২ খণ্ডে ‘রবীন্দ্ররচনাবলী’ অনুদিত হয়েছিল জাপানি ভাষায়। 

    আজুমার স্ত্রী কেইকো ছিলেন রবীন্দ্রগবেষক। বাড়িতে ছিল প্রায় দশহাজার বাংলা বই। মঙ্গলকাব্য থেকে বর্তমান সাহিত্য, সবকিছুরই হদিশ মিলত সেখানে। অসামান্য রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারতেন দুজনেই। উদীয়মান বাঙালি সাহিত্যিকরা কেউ জাপানে গেলেই নিমন্ত্রণ পেতেন আজুমা-সানের গৃহে। বারণ মানতেন না বৃদ্ধ। 

    ২০১১ সালে, সব ছেড়ে রাজার কাছে চলে গিয়েছিলেন জাপানের অমল। 

    ঋণ : প্রবীর বিকাশ সরকার।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @