No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    কাজী কামাল নাসের : যাঁর গানে রয়েছে অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর ভালোবাসার সুর

    কাজী কামাল নাসের : যাঁর গানে রয়েছে অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর ভালোবাসার সুর

    Story image

    ময়টা ২০২০ সালের মে মাস, আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড নামে এক ব্যক্তিকে শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার অপরাধে মেরে ফেলা হয়। প্রায় একই সময়কালে লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, বাড়ি ফেরার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু নিয়ে যখন দেশবাসী নীরব, তিনি লিখলেন, ‘একটা কালো মানুষ মরল বলে, আমেরিকায় আগুন জ্বলে/ আমরা কেমন ভেজা বারুদ জ্বলতে পারি না!’ সাম্প্রতিক অতীতে অতিমারি হোক বা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, তিনি সোচ্চার হয়েছেন। গত তিনদশক ধরে তাঁর গানে প্রাধান্য পেয়েছে সাধারণ মানুষের কথা। তিনি কাজী কামাল নাসের (Kazi Kamal Nasser), প্রচারবিমুখ গানদরিয়ায় ভেসে চলা এক নাবিক৷ 

    ‘কেউ বলছে কিছু বলছে, কেউ মন দিয়ে সব শুনছে…’ — শ্রীকান্ত আচার্যের (Srikanta Acherjee) এই গান ছাপ রেখে গেছে বাঙালি জীবনে। কিন্তু গীতিকার এবং সুরকারের সঙ্গে সেভাবে পরিচিত নন অনেকেই। দারুণ জনপ্রিয় এই গানটিই শুধু নয়, নিজের প্রতিভা দিয়ে বাংলা গানের বিবর্তনে অন্যতম বড়ো অবদান রেখেছিলেন কাজী কামাল নাসের। নব্বই দশকে তাঁর গানে বাঙালি পেয়েছিল ভিন্ন স্বাদ। গান লেখা, সুর করার পাশাপাশি দূরদর্শনে ‘গান শুধু গান’ নামে অনুষ্ঠানে বিচারক হিসেবেও দেখা যায় তাঁকে।

    প্রাইমারিতে পড়াকালীন স্কুলের সাপ্তাহিক গানের ক্লাসে দেশাত্মবোধক গানে গলা মেলাতে মেলাতেই সুরের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। বাবা কাজী গোলাম রসুল ছেলের সংগীতের প্রতি অনুরাগ দেখে প্রথাগত শিক্ষালাভের ব্যবস্থা করেন। বাবার সহকর্মী আশিস গুপ্ত ছিলেন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের লোকগীতির নিয়মিত শিল্পী। তাঁর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি। বিশিষ্ট সুরকার ও শিল্পী শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের কাছে সংগীত শিক্ষার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে চার-পাঁচ বছর নজরুলগীতি শেখার পর আরেক বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দীর্ঘ বারো বছর গান শেখার সুযোগ হয়েছিল। অন্তরা চৌধুরীর (Antara Chowdhury) সঙ্গে গান শেখার সুবাদে সলিল চৌধুরীর (Salil Chowdhury) বাড়িতে যাতায়াত শুরু হয়। রবীন্দ্র ভারতীতে মাস্টার্স করার সময় ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, চণ্ডীদাস মাল, উৎপলা গোস্বামী, অমিয় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখর সান্নিধ্য লাভ করেন তিনি। এর মাঝে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত মানুষের কাছে কীর্তন শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। এভাবেই ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন সংগীতের মায়ায়।

    নাসেরের গানজীবনের সিংহভাগ জুড়ে কবীর সুমনের অবদান একথা তিনি একবাক্যে স্বীকার করেন৷ প্রথম মঞ্চানুষ্ঠান হয়ও সুমনের বদান্যতায়।

    ২০০০ সালে নতুন সহস্রাব্দে পদার্পণ উপলক্ষে সাগরিকা একটি অ্যালবাম রিলিজ করে। শ্রীকান্ত আচার্য, লোপামুদ্রা মিত্র (Lopamudra Mitra), ইন্দ্রনীল সেন (Indranil Sen), শম্পা কুণ্ডু (Shampa Kundu), শিলাজিৎ (Silajit), রূপঙ্কর (Rupankar)-দের গান নিয়ে তৈরি হওয়া সেই অ্যালবামে গান লেখা এবং সুর করার দায়িত্ব এসে পড়ে কাজী কামাল নাসেরের কাছে। অ্যালবামটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করায় নাসেরের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

    নাসেরের গানজীবনের সিংহভাগ জুড়ে কবীর সুমনের (Kabir Suman) অবদান একথা তিনি একবাক্যে স্বীকার করেন৷ প্রথম মঞ্চানুষ্ঠান হয়ও সুমনের বদান্যতায়। কামালের ঝুলিতে তখন সাকুল্যে বাইশটা গান, নতুন গান তৈরি শুরু করেছেন সুমনের অনুপ্রেরণায়। অফিস করে রোজ বাড়িতে ফিরে রাত্রিবেলা খাতা কলম নিয়ে বসেন, শব্দ নিয়ে কাটাছেঁড়া করেন।

    নয়ের দশকের সেই ঝোড়ো দিন, বাংলা গানের ক্ষেত্রে উত্তাল দিন, কবীর সুমন, নচিকেতা চক্রবর্তী (Nachiketa Chakrabarty), পল্লব কীর্তনীয়া (Pallab Kirtania), প্রতুল মুখোপাধ্যায় (Pratul Mukhopadhyay), মৌসুমী ভৌমিক (Mousumi Bhowmik)-দের পাশাপাশি কাজী কামাল নাসেরের গান ছড়িয়ে পড়ছে বাঙালির ঘরে ঘরে। ১৯৯৬ সাল, আকাশবাণী কলকাতার পুজোর গানের দায়িত্বে ছিলেন কবীর সুমন৷  কামাল নাসেরের লেখা তিনটে গান সুমন নিজে সুর করে গেয়েছিলেন। সারাদিনের রেকর্ডিং শেষে নাসেরকে জড়িয়ে ধরে সুমন বলেছিলেন, “কামাল, তোর লেখা এত ভালো হয়েছে, মিটারে এত নিখুঁত যে আমার গাইতে বা সুর করতে কোথাও অসুবিধা হয়নি।”

    খিদিরপুরে যে গলিতে কাজী কামাল নাসেররা থাকতেন সেই একই গলিতে মিনিটখানেক দূরে মুন্না, অর্থাৎ মহম্মদ আজিজ থাকতেন। পার্কসার্কাসে একটা রেস্টুরেন্টে তিনি মহম্মদ রফির গান গাইতেন। হিন্দি ছবির জগতে গান গাইবার বাসনায় মহম্মদ আজিজ চলে যান তৎকালীন বোম্বেতে। তাঁর দেখাদেখি নাসের ভাবলেন বোম্বেতে গিয়ে মিউজিক ডিরেক্টর হওয়ার চেষ্টা করলে মন্দ হয় না। সঙ্গে সামান্য কিছু টাকাকড়ি নিয়ে বম্বে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কদিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলেন বটে, কিন্তু কোনও থৈ পেলেন না। ঘরকুনো বাঙালি, প্রচণ্ড বাড়ির জন্য মন কেমন করে উঠল। ফিরে এলেন বাংলায়।

    নাসেরের গানের বড়ো মৌলিক ব্যাপার হল বিভিন্ন সময়ে সমাজে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা তাঁকে গভীরভাবে আক্রান্ত করে, তারপর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বক্তব্য রাখেন গানের ভাষায়। গানে গানে পক্ষ নেওয়ার একটা দায়িত্ব থাকে। নাসেরের চেতনায় সমাজে দুটো শ্রেণি, এক শোষিত আরেক শোষক। শোষিত মানুষের পাশে থেকেছে তাঁর গানের কথারা।

    নাসেরের গানের বড়ো মৌলিক ব্যাপার হল বিভিন্ন সময়ে সমাজে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা তাঁকে গভীরভাবে আক্রান্ত করে, তারপর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বক্তব্য রাখেন গানের ভাষায়।

    দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, প্রশ্ন তোলার অধিকার কমছে। ফ্যাসিস্ট কায়দায় সুপরিকল্পিত ভাবে নাগরিকদের ওপর অত্যাচার চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। উচিত কথা লিখলে বলা হচ্ছে ‘পাকিস্তানে যাও’। কিন্তু কখনই পিছু হটেনি তাঁর গানের শব্দেরা। বারবার সরব হয়েছেন ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে। আফরাজুল হত্যার বিরুদ্ধে গান লিখেছিলেন। গোমাংস সন্দেহে আখলাক নামক ব্যক্তিকে মেরে ফেলা হল। আখলাখের মৃত্যুতে সরব হয়ে নাসের লিখেছিলেন,

    ‘রাম কী পরবে, রহিম কী খাবে
    কোন পথে বধূ আনবাড়ি যাবে --
    ঠিক করে দিতে চাইছে যারা
    চিনে রাখো তাদের চেহারা।
    তোমার ইচ্ছে, আমার অনিচ্ছে
    সে সবেরও কারা তল্লাশ নিচ্ছে!
    এ সাহস যোগাচ্ছে যারা --
    চিনে রাখো তাদের চেহারা।’

    ‘একটা ছেলে, বিশটা বই’ গান বাঙালি শ্রোতাকে ভাবিয়েছিল। ২০০১ সালে সারেগামা এইচএমভি থেকে প্রকাশিত গানের অ্যালবাম ‘অন্য গল্প বল’-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল এই গান। সামাজিক ইস্যুতে নাসের তাঁর গানকে অন্যপর্যায়ে নিয়ে গেছেন। কখনও মিতুল বা তার বাবা-মায়ের কথা উঠে এসেছে গানে, আবার ‘খোকা হোক’ গানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুত্রসন্তান কামনার প্রতি ঠাট্টা ছুঁড়ে দিয়েছেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর বিরানব্বইয়ে যখন দাঙ্গা হল সারা দেশ জুড়ে, তখন একটা পত্রিকা বেরত ‘প্রতিক্ষণ’ নামে। প্রতিক্ষণ পত্রিকার একটি বিশেষ দাঙ্গা বিরোধী গল্প সংখ্যায় নলিনী বেরার একটি গল্প থেকে নাসের প্রেরণা পেলেন। নিজেই গান লিখে, গাইলেন —

    ‘হঠাৎ দেশে বরফ পড়ে, ছুটল দেশে কম্প জ্বর,
    বরফ জমে দেশটা যেন বরফ ঘর।
    সংবিধানে বরফ জমে ছুটলো দেশে বরফ জ্বর,
    ক্যালেন্ডারেও বরফ চাপা ছ’ তারিখের ডিসেম্বর।’

    প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ (Bangladesh)-এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক লেনদেন সম্পর্কে তাঁর গান সীমান্তে জুড়ে দেয় দুই বাংলার একাত্ম হওয়ার স্বপ্নকে। দুটি দেশের ভাষা-সংস্কৃতি এক, কিন্তু মাঝখানে পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যেই ভালোবাসার চোরাকারবার জারি থাকবে।

    রবীন্দ্রসংগীত (Rabindra Sangeet), নজরুলগীতির (Nazrul Geeti) গাওয়ার পাশাপাশি নাসের তাঁর নিজের লেখা গানে সময়কে তুলে ধরছেন৷ তাঁর ঝুলিতে রয়েছে বিভিন্ন সময়ে রিলিজ হওয়া পুজোর গান৷ কোভিড পরিস্থিতিতে মানুষের কাছে পৌঁছনোর বড়ো ভরসা ইউটিউব। ইউটিউবের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাঙালি শ্রোতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে নাসেরের গান৷ দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলন, কিংবা বিপন্ন মানুষের বিক্ষোভ। তাঁর গানের লাইন চেনাচ্ছে প্রাসঙ্গিকতা,

    ‘কেউ খাচ্ছে, মার খাচ্ছে/ কেউ মার খেতে খেতে জাগছে/ কেউ বিক্ষোভে ফেটে পড়বার আগে/ একটু একটু রাগছে।’

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @