কাটোয়ার কার্তিক লড়াই


কার্তিক শুধু দেবসেনাপতি নন। ইন্দ্রকন্যা দেবাসেনার পতি। সুঠাম চেহারা।বাবরি চুলে সুদৃশ্য পাগরি বা বাহারি টুপি। সরু গোঁফ। দুধে আলতায় মেশানো গায়ের রঙ। হাতে যুদ্ধাস্ত্র; তীর ধনুক। ঋকবেদে কার্তিকের উল্লেখ না থাকলে কী হবে, মহাকাব্য-পুরাণে কার্তিকের জয়জয়কার। অগ্নিদেবতা, যুদ্ধদেবতা, বারাঙ্গনা এমনকি চোরদের দেবতা হিসাবেও একসময়ে বহুল পূজিত। কত তাঁর নাম! স্কন্দ-বিশাখ, গুহ, কুমার, ষণ্মুখ, ষড়ানন, মুরুগণ, সুব্রহ্মণীয়ম ইত্যাদি। দেবতাদের মধ্যে যেন সুপারস্টার। তাঁর জনপ্রিয়তা একসময় ভারতবর্ষের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
গবেষকদের মতে কার্তিক আদতে লোকদেবতা। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে স্কন্দ কার্তিককে ভয়ংকর লৌকিকদেবতা বলা হয়েছে। অপর নাম স্কন্দ। ইনি মূলত যুদ্ধদেবতা। গীতার দশম অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন “সেনানীনামহং স্কন্দঃ সরসামস্মি সাগর।”২৪।। অর্থাৎ সেনাপতিদের মধ্যে আমি দেবসেনাপতি কার্তিক এবং জলাশয়সমূহের মধ্যে আমি সাগর। অন্যদিকে স্কন্দ শব্দটির অর্থ বীজ বা বীর্য। কার্তিক বীর্যবান। সাহসী নির্ভীক শক্তিশালী। আবার স্কন্দ শব্দের অর্থ থেকে বোঝা যায় তিনি কৃষিদেবতা। প্রজননের দেবতা। মোটামুটি এই রূপে আজও কার্তিকের আরাধনা হয় সমগ্র বঙ্গদেশে।
কহলনের রাজতরঙ্গিণী থেকে জানা গেছে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে পুণ্ড্রবর্ধনে অর্থাৎ আধুনিক উত্তরবঙ্গে প্রায় ঘরে ঘরে কার্তিক পুজো হত। শ্রীরামপুর মিশন থেকে ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ওয়ার্ড সাহেবের(W.Ward) বিখ্যাত বই দি হিন্দুস দ্বিতীয় খণ্ডে কার্তিকপুজো সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। যেমন কলকাতাসহ অন্যান্য শহরে প্রচুর কার্তিকপুজো হত। অনেক স্থানে প্রায় ২৫ হাত লম্বা কার্তিকঠাকুর পূজিত হতেন। পুত্রসন্তান কামনায় অনেকেই আবার কার্তিকব্রত পালন করতেন। এই ব্রতের অন্যতম অঙ্গ ছিল দম্পতিকে মহাভারত পাঠ শোনানো। প্রাচীন বরেন্দ্রভূমি মালদহের সাহাবাড়ির কার্তিক চতুর্ভুজ বাঁকিবিহারীলালের পুজো আজও বিখ্যাত। এই পরিবারের বিশেষ প্রথা হল প্রথম পুত্রসন্তান হলে একটি করে দেবপ্রতিমার বাড়তি পুজো ও দেবালয়ে সংরক্ষণ। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি বেলডাঙা, হুগলির বাঁশবেড়িয়া, বাঁকুড়ার সোনামুখীর কার্তিকপুজোও বেশ জমজমাট।
তবে কাটোয়ার কার্তিকপুজো ‘কার্তিক লড়াই’ নামে সুপরিচিত। কথিত আছে - বারবিলাসিনীদের কার্তিকপুজো আর শহুরে জমিদারদের মধ্যে এই নিয়ে প্রতিযোগিতার সূত্রে উৎসবের বাড়বাড়ন্ত। যদিও কাটোয়ার কার্তিকপুজো সম্পর্কে কাটোয়ার মিশনারিদের লেখায়, নিবারণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কাটোয়ার ইতিহাস'-এ আদৌ কোনও উল্লেখ নেই। তবে কাটোয়া মহকুমায় কার্তিক-উপাসনার ইতিহাস অতি প্রাচীন। মঙ্গলকোটের প্রত্নক্ষেত্র থেকে গুপ্তযুগের টেরাকোটা কার্তিকমূর্তি মিলেছে। এই অঞ্চলের রাজাকার্তিক এবং ন্যাংটো কার্তিক আজও গ্রামে গ্রামে পূজিত হয়। নবান্ন উৎসবে গ্রামে গ্রামে অন্নপূর্ণার সঙ্গে নবানে/পান্তা কার্তিক পুজো অন্যতম আকর্ষণ। নবদম্পতি বিশেষ করে যাদের এখনো সন্তানাদি হয়নি তাদের বাড়িতে লুকিয়ে দিয়ে আসা হয় একফুট উচ্চতার বাবুকার্তিক। এই কার্তিকের গড়ন বড় বিচিত্র। মাথায় পাগড়ি। হাতে তীরধনুকের পরিবর্তে কদমফুল। গলায় উত্তরীয়। পরনে কাপড়। কটিতে জড়ানো মেখলা। পোষাকি নাম খোকাই-কার্তিক।
কাটোয়া অতি প্রাচীন শহর। গ্রিক-রোমান লেখকদের রচনায় উল্লিখিত 'কটদুপা'কে একালের কাটোয়া বলে অনেকেই শনাক্ত করেছেন। তবে শহর কাটোয়ার খ্যাতি শুরু মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের পর থেকে। মুর্শিদাবাদে নবাবিরাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে কাটোয়া শুধু মুর্শিদাবাদের প্রবেশদ্বার হয়ে ওঠেনি, ব্যবসা বাণিজ্যে জমজমাট হয়ে ওঠে। নতুন নামকরণ হয় গঞ্জমুর্শিদপুর। ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে আবার কাটোয়া শুধু বাণিজ্যেকেন্দ্র নয় - বঙ্গরাজনীতির অন্যতম আখড়া। কারণ পলাশীর যুদ্ধের নীলনক্সাটি প্রস্তুত হয়েছিল কাটোয়াতেই।

কাটোয়ার গঙ্গাতীরে বর্তমান হরিসভাপাড়ার প্রাচীননাম চুনুরিপাড়া। এই পাড়াতেই বাবু, জমিদার আর বণিকদের আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে গড়ে উঠেছিল পতিতালয়। এই পতিতাদের পূজিত ন্যাংটো শিশুকার্তিকের উপাসনা থেকেই কাটোয়ায় কার্তিকপুজোর শুরু। সময়ান্তরে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও সেই ন্যাংটো কার্তিকের উপাসনা আজও শহর কাটোয়ার অন্যতম প্রাচীন পুজো। সন্তান কামনায় মহিলারা এই শিশুকার্তিকের কাছে মানত করেন। মুড়িরনাড়ু, খেলার বল, খেলনা ঢোল, বেলুন ইত্যাদি কত উপহার! তাহলে লড়াই?

লোকশ্রুতি অনুসারে, বারবিলাসিনীদের পুজোকে কেন্দ্র করে তাদের রক্ষক বাবু জমিদার বণিকদের মধ্যে তৈরি হত প্রতিযোগিতা বা লড়াই। কালক্রমে শোভাযাত্রা কার্তিক লড়াই নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। এখন সেই লড়াইয়ের আঁচ পড়েছে প্যান্ডেল ঠাকুর থিম আলো বাজনা আর অবশই সেই শোভাযাত্রায়। পাড়ায় পাড়ায় বা ক্লাবে ক্লাবে এই নিয়ে জোরদার টক্করের লড়াই।
কাটোয়ার কার্তিকপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য থাকাপুজো। প্রাচীন থাকার কার্তিকপুজো তাঁতিপাড়ার সাতভাই পুজো। এমনিতেই কাটোয়ার তাঁতিপাড়া প্রাচীনত্ব ও বনেদিয়ানায় ঊজ্জ্বল। এখনো নব্বই শতাংশ তন্তুবায়রা বসবাস করছেন। রয়েছে ধর্মরাজের আস্তানা, বর্গিহাঙ্গামার স্মৃতিবাহী লক্ষ্মীনারায়ণজিউর মন্দির আর এই সাতভাই থাকা কার্তিক। কথিত আছে ছেলেপুলেরা খেলতে গিয়ে বর্তমান ঠাকুরের থানের কাছে সাতটি খেলার ভেঁটা কুড়িয়ে পায়। আর সেই থেকেই সাতভাই কার্তিক পুজোর সূচনা। সবার উপরে বড়ভাই। দুদিকে তিনটে করে সব মিলে সাতভাই। মাথায় বাবরি চুল। বেশ দশাসই চেহারা। জমিদারি গোঁফ। পায়ের উপর পা তুলে দিব্যি আয়েস করে বসে। ময়ূর থাকলেও হাতে তীর ধনুকের পরিবর্তে গোলাপ ফুল। একেই বলে রাজাকার্তিক। এখানে আবার মানতের অদ্ভুত নিয়ম। একমুঠো লবণ আর গঙ্গাজল দিয়ে যে কেউ মনের ইচ্ছাপূরণের জন্য মানসিক করতে পারেন। দধিকর্মার দিনে মুড়ির মোয়া বিতরণ করা হয় ঠাকুরতলায়। রাজা কার্তিকও মোয়া ভালোবাসেন।

কাটোয়ার কাঠগোলা কাশিগঞ্জ পাড়ার 'বাংরাকার্তিক' বেশ পুরাতন। যোদ্ধা কার্তিক। গঙ্গাতীরবর্তী এই সূত্রধরপাড়ায় আজও অধিকাংশই সূত্রধর সম্প্রদায়েরাই বাস করেন। প্রায় আট ফুট উচ্চতার ময়ূরে চেপে রণংদেহী মূর্তি। বর্তমানে দুপাশে দুটি সখি থাকলেও পূর্বে ছুটন্ত ঘোড়া ছিল। অনেকেই মানত করেন। বাজনা আলো বা সোনার আংটি, চাঁদির মোয়া ইত্যাদি। প্রতিমাশিল্পী পাড়ার সূত্রধরেরা। এই তিনটি প্রাচীন পুজো ছাড়াও সাহেবকার্তিক রামকার্তিক জামাইকার্তিক ইত্যাদি বিচিত্র প্রকারের কার্তিক পুজো আসে। আগে থাকাপুজো হতো বেশ কয়েকটি। বর্তমানে থাকা থেকে থিমের টান বেশি। কাটোয়ায় পারিবারিক ও সার্বজনীন পুজো মিলিয়ে প্রায় দুশোটির বেশি পুজো হয়। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন দৃশ্যসজ্জা সিনারি আর থিমের পুজো। গোটা শহরটাই রঙিন আলোয় সাজানো হয়। সুদৃশ্য গেটগুলো দেখার মতো। প্রতিটি পুজোয় আসে তিন থেকে পাঁচ সেট বাজনা। চন্দননগরের আলোর মায়াবি বিন্যাসে, বড় বড় প্যান্ডেলের চমকে, মেলায়, দোকান বাজারে আর লক্ষাধিক জনসমাগমে কাটোয়ার কার্তিক পুজোর যথার্থ পরিচিতি ‘কার্তিক লড়াই’।