অবনীন্দ্রনাথের ‘আকবরি মোহর’-কে ‘কণিকা’ নাম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ

কালবৈশাখী সেদিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভুবনডাঙায়। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। যথারীতি, বৃষ্টির সঙ্গে সুর মিলিয়ে গাইতে গাইতে মেয়েটা ছুট লাগিয়েছে লালমাটির পথ ধরে। গুরুপল্লি থেকে উত্তরায়ণ, তারপর শ্যামলীর দালান। ঝড়-বৃষ্টি হলে তাকে ঘরে বেঁধে রাখে কার সাধ্যি! ভিজে সপসপ করছে গা। মেয়েটার খেয়ালই নেই। হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ালেন একজন বিরাট মানুষ। এত্ত লম্বা যে মাথা উঁচু করে দেখতে হয়। সাদা চুল-দাড়ি, গভীর এক চোখ। মেয়েটিকে বললেন, “গান জানিস?’’ মেয়েটিও খুশিতে ডগমগ হয়ে গান শুনিয়ে দিল। আর, ইতিহাসের চাকাও গড়াতে শুরু করল সেদিনের বৃষ্টি-পিচ্ছিল পথ ধরে।
মেয়েটির নাম অণিমা। সেই ইয়াব্বড়ো মানুষটা তাঁর নাম বদলে দিলেন ‘কণিকা’-য়। সে যেন মেয়েটির দ্বিতীয় জন্ম। এরপর ডাক পড়ল গান শেখার। ‘গুরুদেব’ নিজেই নতুন গান শেখালেন। ‘একদিন চিনে নেবে তারে’। শুধু গান শেখানোই না, নিজের হাতে খাতায় সে গান লিখেও দিলেন তিনি। অবশ্য, রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা যে কতখানি দুর্লভ তা তখনো বোঝার মতো বয়সই হয়নি ‘মোহর’-এর। “কত চিরকূট, কত ছবি, কত তাঁর হাতের লেখা নিত্যনতুন দেখেছি, পেয়েছি। আমার কাছে সে-সব ছিল খুবই সহজ। সে-সব জমিয়ে রাখার কথা ভাবিনি।” লিখেছিলেন তিনি। জীবনের শেষ অধ্যায়ের কোনো এক পাতায়।
মোহর তথা কণিকার বাল্য আর কৈশোর জুড়ে রবীন্দ্রনাথ। প্রিয় মোহরকে নিজে একাধিক গান তুলিয়েছেন তিনি। গান শেখার পাশাপাশি অভিনয়। সেও ‘গুরুদেবের’ হাত ধরেই। উদয়নের হলঘরে ‘তাসের দেশ’-এর রিহার্সাল চলছে। কণিকা গানের দলে। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বললেন, “ওঠ্ তো, তুই পারিস কি-না, দেখি।” দহলানীর ভূমিকায় জীবনের প্রথম অভিনয় উতরে গেল ভালোভাবেই। গুরুদেবের প্রশংসাও জুটল। মোহরকে আর পায় কে!
আরো পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের গানের শেষ ও শেষের গান
এরপর ‘ডাকঘর’ নাটকে সুধার চরিত্র। অভিনয় শেখাচ্ছেন ‘গুরুদেব’-ই। রিহার্সালের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ গেয়ে উঠতেন ‘সমুখে শান্তিপারাবার’ গানটা। তারপর বলতেন, “আমার মৃত্যুর পর এ-গানটি যেন গাওয়া হয়।” শুনেই মনখারাপ হয়ে যেত মোহরের। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় প্রথম অনুষ্ঠান ‘বর্ষামঙ্গল’। কলকাতার শিল্পীদের পাশাপাশি তেরো বছরের মোহরও আছে গানের দলে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে একাধিক রিহার্সালের পর অনুষ্ঠান। স্টেজের একপ্রান্তে ডেকচেয়ারে বসে রবীন্দ্রনাথ। সেই চেয়ারের হাতল ধরেই মোহর গাইলেন ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। গানের মাঝেই বিস্ময় ঘিরে ধরল তাঁকে। এ কী, গুরুদেব যে নিজেও গাইছেন!
১৯৪০ সালের ২৪ জুলাই, বোলপুর স্টেশন কেন্দ্রের সূচনা করলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে গুরুদেবের শেখানো গানই গাইলেন কণিকা। রেডিয়োয় মোহরের গান ছড়িয়ে পড়ল দূর-দূরান্তে। সেই মুগ্ধতা বয়ে আনল শ্রোতাদের পাঠানো চিঠির ঢল। এরই সঙ্গে বাইরের জগতটাও যেন এসে পৌঁছল কণিকার কাছে। সেই শুরু। এবার শান্তিনিকেতনের মোহরকে আরো নিবিড়তায় আবিষ্কার করবে বাংলা তথা গোটা দেশ। তার শুরুটাতেও জড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অবশ্য শিক্ষক হিসেবে শান্তিদেব ঘোষ আর শৈলজারঞ্জনকে পেয়েছেন কণিকা। শৈলজারঞ্জনের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা বেশি। ‘শৈলজাদা’ কিন্তু অবিরাম বকুনি দিতেন তাঁকে। একবার শৈলজারঞ্জনের সঙ্গেই ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ থেকে কয়েকটা গান রেকর্ড করতে গ্রামাফোন কোম্পানিতে গেছেন কণিকা। ‘শুনলো শুনলো বালিকা’ গানে সঞ্চারীতে পৌঁছে গলা কিছুতেই নামছে না। শৈলজারঞ্জন শুরু করলেন বকুনি। কণিকা লিখছেন, “আমার নাকি মাথা মোটা—আমি মোটেও গান গাইতেই পারি না। আমি নাকের জলে চোখের জলে অস্থির।” শৈলজারঞ্জন কোনোদিনও বলেননি, “তোমার গান ভালো হয়েছে, মোহর।” অভিমান ঘন হয়। শেষে একদিন এহেন শৈলজারঞ্জনই তাঁকে অবাক করে দিয়ে বলেন, “মোহর তোমার খুব অভিমান আমার ওপর তাই না? কোনোদিনও মুখে তোমার গানের প্রশংসা করিনি। আজ আমি বলছি, আমার মতে তোমার মতো রবীন্দ্রসংগীত কেউ গাইতে পারে না, আর অতুলপ্রসাদের গানেও আমার তোমার চাইতে কাউকেই ভালো লাগে না।”
মোহরকে অবাক করে দিয়েই ‘আকবরি মোহর’ নাম দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। ‘নটীর পূজা’-য় রত্নাবলী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মোহর। সে-কথা মাথায় রেখে তাঁর বিয়েতে ‘নটীর পূজা’-র ছবি এঁকে উপহার দিয়েছিলেন অবন ঠাকুর। কণিকা লিখেছেন, “আমার গান পছন্দ করতেন তিনি। ভালোবাসতেন।”
শান্তিনিকেতনের ‘মোহর’-কে তো ভালোবাসতেন অসংখ্য মানুষ। তার মধ্যেই কেউ কেউ বিশেষ। যেমন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। কণিকা তাঁকে বলতেন, ‘জ্যোতির্ময় পুরুষ’। দুজনেই দুজনের গুণমুগ্ধ, হয়তো রূপমুগ্ধও। চিঠি চালাচালি চলত। শেষবার বিশ্বভারতীতে বাজাতে এসেও রবিশঙ্কর এসেছেন কণিকার বাড়িতে। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, “মোহর, কেমন আছো? তুমি তো সেই আগের মতোই সুন্দরী রয়েছ।’’ কণিকা তখন লজ্জায় মুখ ঢেকেছেন শাড়ির আঁচলে। যাওয়ার আগে বলে গেছেন, ‘‘মোহর, দেখা হবে।” তারপর, ওপরে আঙুল দেখিয়ে বলেছেন, “চাই এখানে, চাই এখানে।’’
জীবনে সম্মান, খ্যাতি কম পাননি কণিকা। প্রাপ্তির মাঝে অপ্রাপ্তির কাঁটাও ছিল হয়তো কিছু। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সদ্ভাব ছিল। ‘আগন্তুক’ সিনেমায় সাঁওতাল নাচের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন কণিকাই। কিন্তু সত্যজিতের সিনেমায় গান গাওয়া হয়নি তাঁর। সত্যজিৎ তাঁকে বলেছিলেন, “আপনার কণ্ঠকে ব্যবহার করার মতো সে রকম জায়গা পাইনি।’’ শুনে কি অভিমান হয়েছিল তাঁর? জানা নেই।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে আদি-অকৃত্রিম প্রথম পুরুষ। তাছাড়াও তাঁকে ঘিরে, জুড়ে ছিলেন আরো অসংখ্য গুণী মানুষ। আর তাঁদের সবাইকেই সুরে ভরিয়ে রেখেছিলেন বাংলার ‘মোহর’।
তথ্যঋণ: ‘আনন্দধারা’, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আজকাল পাবলিশার্স; ‘বলেছিল আর কলকাতায় যাব না’, প্রিয়ম মুখোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা।