No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    শান্তিনিকেতনের বর্ষামঙ্গল, মোহর গাইছেন গুরুদেবের শেখানো ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’   

    শান্তিনিকেতনের বর্ষামঙ্গল, মোহর গাইছেন গুরুদেবের শেখানো ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’   

    Story image

    তেরো নাকি সংখ্যার বিচারে অশুভ! তা সেই গেরো মাথায় নিয়েই বছর তেরোর মেয়েটি কাকা গোকুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল কলকাতায়। লালমাটির সারল্য মাখা, এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়ানো কিশোরী ভাইজিকে এরপর কাকা নিয়ে যান ৬/১ অক্রুর দত্ত লেনে হিন্দুস্তান কোম্পানির অফিসে। ইচ্ছা, কী করে গান রেকর্ড হয় তা দেখাবেন ভাইজিকে। সর্বক্ষণ সুরের নদীতেই খেয়া ভাসায় সে মেয়ে। কেউ গান গাইতে বললে বিনাবাক্যে রাজি হয়। আগেও হয়েছে এমন, এবারেও তাই হল। কোম্পানির মালিক সেই কিশোরীর গানে মুগ্ধ হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে দিয়ে দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করালেন। সে গান শুনে এদিকে তখন  অভিমানী রবীন্দ্রনাথ। হবে নাই বা কেন! এই যে নিজের এত গান তিনি ছোট্ট মেয়েটাকে শেখালেন সেসব কি একটাও গাওয়া যেত না! একটু বেশিই যে স্নেহ করেন তাকে রবীন্দ্রনাথ। তাই এই ছদ্ম মনোমালিন্য। সম্পর্কের মাধুর্যের এক অপূর্ব কথোপকথন। এ মাধুর্য কেমন তা সবচেয়ে বেশি জানে শান্তিনিকেতনের পথ ঘাট, ফুল পাতার জঙ্গল। সে মেয়ে যে তাদেরই ‘মোহর’। রবীন্দ্রনাথের সুরকে নিজের গলায় লালন করা শান্তিনিকেতনের মোহর। গুরুদেবের মোহর।

    সেই ঝড়ের বিকেল মনে পড়ে। আশ্রমের গাছপালাগুলো একে অন্যের গায়ে হেলে পড়ছে, ধুলো উড়ছে চারদিকে। আর সেই ঝড় মাথায় করেই ছোট্ট সে মেয়ে এক দৌড়ে ছুটেছে আশ্রমের উত্তর দিকে। ‘উত্তরায়ণে’ আম, জাম, গাব, শিমুল না কুড়োলে হয় সেসময়! বৃষ্টির জলে ভিজে যখন চুপসি, তখন সে মেয়ে দেখল দূরে দাঁড়িয়ে আছেন সাদা চুল, সাদা গোঁফ দাড়ির অপূর্ব মানুষটি। চিনতে অসুবিধে হল না। এ শান্তিনিকেতন তো তাঁর জন্যই। এঁর গানই তো সর্বক্ষণ গুণগুণ করে সে। ‘ঝড়ের মেয়ে’-কে কাছে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করলেন রবীন্দ্রনাথ। গান শুনতে চাইলে ছোট্ট মোহর তাও শোনাল। গুরুদেব বললেন, “মাঝেমাঝে এসে আমায় গান শুনিয়ে যাস।” তারপর একদিন পিতৃদত্ত নাম ‘অণিমা’ বদলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সে মেয়ের নাম রাখলেন ‘কণিকা’। তাঁর গলায় নিজের যে গান সযত্নে রাখলেন কবি, আজীবন তাকে লালন করেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে প্রতিবার তা গাওয়ার মধ্যে গানের যে নতুনতর মাত্রা থাকে, সেই মৌলিকতা কণ্ঠে বাসা বেঁধেছিল কণিকার। রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গেলেই তিনি হারিয়ে যান কোথাও। নিজেই বলেন, “তাঁর গান যখন গাই সেই সুরের সঙ্গে, কথার সঙ্গে, আমার সঙ্গে আর প্রকৃতির সঙ্গে যেন কোনও পার্থক্য খুঁজে পাই না।”

    এক গাছের ছাল যেভাবে অন্য গাছের বল্কল হয়ে ওঠে, ঠিক সেভাবে কণিকা ওরফে মোহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের শান্তিনিকেতনে আসা। এ পরিবারের রক্তে সুর। মা অনিলাদেবী খুব ভালো গান গাইতেন। বাবা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় বাজাতেন এসরাজ। রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ রাজেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইজি ছিলেন অনিলা। আবার রাজেন্দ্রলালের পরিচিত এই সত্যচরণ। রাজেন্দ্রলালই তাঁকে নিয়ে আসেন শান্তিনিকেতনে। তারপর থেকে এখানেই সত্যচরণের থাকা, অনিলাদেবীকে বিয়ে করে সংসার পাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়ে রবিজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের সহকারি হিসেবে যুক্ত হওয়া। অথচ ১৯২৪-এ মোহর জন্মান মামাবাড়ি বাঁকুড়ার সোনামুখিতে। জন্মই শুধু শান্তিনিকেতন থেকে দূরে, কিন্তু কণিকার জীবনের বাকি সব মুহূর্ত এই শান্তিনিকেতনকে ঘিরেই। 

    আশ্রমের এ পল্লি থেকে ও পল্লিতে ছুটে বেড়ানো,  রবীন্দ্রনাথ, দীনেন্দ্রনাথ, ইন্দিরা দেবীচৌধুরানির কাছে ছোটো থেকে গান শেখা এই মেয়ে প্রকৃতই ‘আশ্রমকন্যা’। প্রাণখোলা, দরাজ স্বভাবে সকলের প্রিয় সে। নোবেল প্রাপ্তির পর কত বিখ্যাত সব মানুষ গুরুদেবকে দেখতে আসত, সবার সঙ্গে কথা হত তাঁর। গান্ধিজি, নেহেরু, এন্ড্রুজসাহেব, সরোজিনী নাইডু সবাইকেই কণিকার মনে হত নিজের লোক।  কারণ তাঁরা রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষ, আর কণিকার কাছে গুরুদেব সবকথা নিশ্চিন্তে ভাগ করে নেওয়ার বিশ্বস্ত আশ্রয়।

    মোহর — কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্র

    দুজনের সম্পর্কটি ছিল কোমলতায় মোড়া। পরে স্মৃতিচারণা করেছেন মোহর, “যখনই ওঁর কাছে যেতাম, তখনই উপহারস্বরূপ হাতে এসে যেত লজেন্স বা বাদাম। আমার নানা দেশের স্ট্যাম্প জমানোর নেশা ছিল। রোজই প্রায় তাঁর কাছে যেতাম স্ট্যাম্প নিতে”। ক্ষিতিমোহন সেনের মেয়ে, অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেনের লেখায় পাই, “বাড়ির জানলা দিয়ে কতদিন দেখেছি মাঠের মধ্যে দিয়ে মোহর ছুটছে গুরুদেবের কাছে। রাস্তা দিয়ে যেত না, পাছে দেরি হয়ে যায়। মাঠের কাছে একটা বনপুলকের গাছ ছিল।... তার তলা দিয়ে মোহর দৌড়াচ্ছে, তাড়াতাড়িতে ফ্রকের পিঠের সব বোতামও হয়তো লাগানো হয়নি।” কণিকার পড়াশোনা, নাচ, গান, খেলাধুলো, ছবি আঁকা সবেতেই যোগ প্রকৃতির আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। গুটিপোকা থেকে রঙিন প্রজাপতি পাখনা মেলেছিল রবীন্দ্রনাথের হাতেই। রসায়নের শিক্ষক শৈলজারঞ্জন রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতেই সংগীত ভবনের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। গুরুদেবের নির্দেশে এই শৈলজারঞ্জনকেই গানের গুরু হিসেবে বরণ করেছিলেন মোহর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের সব সত্যের সঙ্গে জুড়ে থাকা এক নাম। তাই গুরুদেবের কথা সবসময়ই তাঁর কাছে বেদবাক্য। তবে কারণে অকারণে মোহরের রাগ, নালিশ, অভিযোগ শোনার মানুষটিও রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালে বর্ষামঙ্গলে প্রথমবার মঞ্চে গাইছে মোহর, গুরুদেবেরই শেখানো গান ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের মনে হল সে মেয়ে বুঝি বড্ড চিন্তায়। তার সঙ্গেই গাইতে শুরু করলেন কবি। যখন তখন মোহরকে রবীন্দ্রনাথ ডেকে পাঠাতেন গান শেখাবার জন্য। গল্পের ঝুলি খুলে যেত অনায়াসেই। কারোর কাছে বকুনি খেয়ে এসেও কবির কাছে কলকল করে নালিশ জানাত ছোট্ট মোহর। কবি হেসে ফেলতেন। রবীন্দ্রনাথের সস্নেহ প্রশ্রয়ে কণিকা তখন কখনও ‘তাসের দেশ’-এর ‘দহলা’, কখনও ‘ডাকঘর’-এর ‘সুধা’ আবার কখনও ‘বিসর্জন’-এর ‘অপর্ণা’ হয়ে মহড়া দিচ্ছে।

    চৌদ্দ বছর বয়সে ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে’ আর ‘না না না ডাকব না’ এই দুটি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করে যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবিগানের ভেলায় ভাসার শুরু তা বহমান ছিল তাঁর পূর্ণবয়স পর্যন্ত। প্রথম রেডিওয় গাওয়া গানও রবীন্দ্রনাথের শেখানো গান ‘ওগো তুমি পঞ্চদশী’। অসুস্থ শরীরেও কবি গান শেখান মোহরদের, ‘ওই মহামানব আসে’।  এক শ্রাবণে দেখা হওয়ার দিন ফুরোয় আরেক শ্রাবণে। কলকাতার খবর বিশ্বভারতীতে পৌঁছালে চোখের জলে পুরোনো লাইব্রেরির সামনে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে মোহর গেয়েছিলেন কবিরই শেখানো সে গান ‘সমুখে শান্তি পারাবার’। এরপর যে গান তাঁকে বড়ো করল সে গানকে ছড়িয়ে দেওয়ার সময়।  বিশ্বভারতীর অধ্যাপিকা হিসেবে, প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশে বিদেশে পৌঁছে দিয়েছেন রবিগানকে। তৈরি করেছেন অজস্র গুণী নিষ্ঠাবান ছাত্রছাত্রীকে। আর এ কাজে তাঁর নীরব সহকারি, গুণমুগ্ধ ভক্ত তাঁর স্বামী বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিগানের পাশাপাশি কিছু অতুলপ্রসাদী, নজরুলগীতি, আধুনিক গান গাইলেও রবীন্দ্রনাথের গানের যে ‘আনন্দধারা’ মোহর বইয়ে ছিলেন ভুবন জুড়ে, তাতে তিনিই এক স্বতন্ত্র ঘরানা।
        
    আজও শান্তিনিকেতনের গাছপালা, করবি, পলাশ, বৃষ্টিদিনের লালমাটি হয়তো দেখে গান মুখে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে ছুটে বেড়াচ্ছেন মোহর, অবনীন্দ্রনাথের ‘আকবরী মোহর’। সকলের চেয়ে আলাদা সে, সারল্যই তাঁর মৌলিকতার মূল। অমল মেঘ বাতাসে ভেসে চলে যেমন তেমনই স্থূলশরীরটা চলে যাওয়ার বছর কুড়ি পরেও এই জন্মদিনের সকালে আশ্রমকন্যা মোহর ছুটে চলেন গানের সুরে। আশ্রমপল্লীর অলিতে গলিতে একটা করে কুঁড়ি ফোটে, ফুলের ঘুম ভাঙে, গাছপালা সব জেগে ওঠে তাঁরই জন্য। তাঁকে নতুন গান শোনাতে হবে যে!  আজ যে তাদের মোহরেরই জন্মদিন!

    তথ্যঋণঃ আনন্দধারা, আজকাল পাবলিশার্স প্রা.লি., ১৯৯৮ 
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @