অঙ্কে শূন্য পেয়ে ছোট্ট মোহর মাস্টারের নামে নালিশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে

অনেক বয়স হবার পর ভিটিলিগোতে আক্রান্ত হয়েছিলেন মোহর, তখন বিদেশ থেকে অনেক দাম দিয়ে তাঁর জন্য ওষুধ আনানো হয়েছিল। সেই ওষুধ একদিনও ব্যবহার করেননি, দিয়ে দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী এক তরুণীকে৷ এই প্রসঙ্গে তাঁকে যখন সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা জিজ্ঞাসা করেন, তখন তিনি অকপটে বলেছিলেন, “ঈশ্বর যখন যা দিয়েছেন নিয়েছি। কখনও প্রত্যাখ্যান করিনি৷ এখন যখন তিনি এই রোগ দিলেন, আমি প্রত্যাখ্যান করতে চাইছি, এর থেকে মুক্তি চাইছি, এ তো ঠিক নয়। তার চেয়ে বরং যার জীবন সবে শুরু হচ্ছে এই ওষুধ তার কাজে লাগুক৷”
সূর্য প্রায় অস্তমিত। ঘন সবুজ পাইনবনের বুক চেরা পাকদণ্ডী পথ বেয়ে হেঁটে চলেছেন তিনজন। দুইজন পুরুষ, আরেকজন মহিলা। মহিলা যিনি, তাঁর বেশভূষা সুকোমল লালিত্যে মাখা। হালকা রঙের শাড়ির উপর একটি গাঢ় রঙের শাল দেওয়া, চুল সুবিন্যস্ত। যেন শেষের কবিতার লাবণ্য। যাচ্ছেন তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী, তাঁর স্বামী আর ভ্রাতৃসম দুইজনকে নিয়ে এক মাতাজির সঙ্গে দেখা করতে। বহমান অলকানন্দার তীরে ছোট্ট একটি কুঠিয়ায় তাঁর বাস। সেখানকার একটি গাছে অবিরাম ডেকে চলেছে দুই নীল পাখি। পাখির ডাক আর জলের শব্দ ছাড়া কোথাও আর কোনো শব্দ নেই।
সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস (বাঁদিক থেকে)
মাতাজির কক্ষে একটি প্রদীপ অকম্পিত ঊর্দ্ধমুখী শিখায় জ্বলছে৷ তার সম্মুখে মাতাজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কিছুক্ষণ পরে আরেকজন রোগামতন সাধু সেই কক্ষে এলেন। দর্শনার্থী মহিলাটির সঙ্গে পরিচয় হতেই তাঁর গলা দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বেরিয়ে এল বিস্ময়ের স্বর—
“কে, আমাদের মোহর? মানে সত্যদার মেয়ে?”
এই বলে তিনি মোহরের হাতে তুলে দিলেন কয়েকটি সাদা ফুল। শান্তিনিকেতনে পাঠরত তিনি ছয় সাত বছরের ছোট্ট মোহরকে দেখলেই বলতেন, “এই মোহর, একটা গান শোনাবি?” সেই তিনিই এখন হিমালয়বাসী। সনাতন আধ্যাত্মবাদ আর রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মবাদ, এই দুইয়ের প্রভাবে নাকি তাঁর এই পথে আসা। এদিকে মোহর পণ করেছিলেন পাহাড়ে এসে তিনি গাইবেন না। কিন্তু সন্ন্যাসীর সঙ্গে অনেক গল্পের পর সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে বসে তিনি গান ধরলেন। মহাবিশ্বে মহাকাশে আর আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। চারদিক নিস্তব্ধ। অলকানন্দার ধ্বনি আর গোধূলির আঁধারের মাঝখানটিতে গেরুয়া বসন পরিহিত এক সাধিকার সম্মুখে আরেক একাকী বীণার সুর ঝংকৃত হল, যে বীণার নাম কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। শান্তিনিকেতনের ধুলোমাটিতে যাঁর গান তৃণের আগায় ফুল ফোটায়।
মোহর পণ করেছিলেন পাহাড়ে এসে তিনি গাইবেন না। কিন্তু সন্ন্যাসীর সঙ্গে অনেক গল্পের পর সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে বসে তিনি গান ধরলেন। 'মহাবিশ্বে মহাকাশে' আর 'আনন্দধারা বহিছে ভুবনে'। চারদিক নিস্তব্ধ।
রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছেন একদম ছোট্টবেলা থেকে কিশোরীবেলার শুরু অবধি৷ মোহরের ভেতরের আধ্যাত্মিকতার জাগরণ তখন থেকেই হয়তো। পরে যত বড়ো হয়েছেন জীবনদেবতার উপর তাঁর বিশ্বাস ততই দৃঢ় হয়েছে। রবীন্দ্রগানের যে গভীরতা, নির্জনতাকে তিনি চিনতে পেরেছিলেন তেমন করে যেন আর কেউ পারেননি। চিরকালীন নম্র, অন্তর্মুখী মোহর আধ্যাত্মিকতার সাগরে আকণ্ঠ ডুবেছিলেন আমৃত্যু। শুধু রবীন্দ্রসংগীতের দর্শন নয়, অন্যান্য অভিজ্ঞতা দিয়েও নিজের দর্শনকে বিকশিত করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের দীর্ঘ পঁচিশ বছর পরে তাঁর জীবনে আরেক মহাত্মার আবির্ভাব হয়, যাঁকে তিনি ডাকতেন সাধুবাবা বলে।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং লতা মঙ্গেশকর
রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছেন একদম ছোট্টবেলা থেকে কিশোরীবেলার শুরু অবধি৷ মোহরের ভেতরের আধ্যাত্মিকতার জাগরণ তখন থেকেই হয়তো। পরে যত বড়ো হয়েছেন জীবনদেবতার উপর তাঁর বিশ্বাস ততই দৃঢ় হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণের দেহরক্ষার যে অতি পরিচিত ছবিটি, সেখানে অনেকের মাঝে নাকি সেই সাধুবাবাকেও উপস্থিত দেখা যায়। অথচ তার এত বছর পরে কণিকা যখন সাধুবাবাকে দেখলেন তখনও তাঁর চেহারা একইরকম৷ একেবারেই ছাপোষা একজন মানুষ। সারাদিনে কাপের পর কাপ চা খান আর বিড়ি টানেন। তাঁর কাছে দীন-দরিদ্রের যাতায়াতই বেশি। এইরকম একটা পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের দীক্ষায় দীক্ষিত কারো পদধূলি পড়া তেমন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু সমস্ত আভিজাত্যকে বাক্সবন্দি করে শান্তিনিকেতনের মাটির মেয়ে মোহর রোজই ছুটে যেতেন তাঁর নতুন বাবার কাছে৷ যেন পরম আত্মীয়, পরম নির্ভর। অঙ্কে শূন্য পেয়ে ছোট্ট মোহর একবার তৎকালীন অঙ্ক মাস্টার ধনপতিদার নামে নালিশ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে। সেইসময় রবীন্দ্রনাথ যেন ছিলেন তাঁর সমস্ত সমস্যার গতি।
তাঁর প্রয়াণের এত বছর পরে এই সাধুবাবা যেন সেই খালি জায়গাটিতে এসে বসলেন। অথচ দুইজনের মাহাত্ম্য দুইরকম। একবার রবীন্দ্র সদনে এক অনুষ্ঠানে সাধুবাবার আশীর্বাদের উপর ভর করে ভাঙা গলা নিয়েও চমৎকার গান গাইলেন মোহর। বাবার আশীর্বাদের এই ম্যাজিক দেখে বাবার উপর তাঁর বিশ্বাস হয়েছিল আরও দৃঢ়। দিন যত গেছে বাবার প্রতি, ঈশ্বরের প্রতি তাঁর এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে। ঈশ্বরের পূজায় যেন কণিকার গান একেকটি ফুল। তাঁর সুর যেন চন্দনচর্চিত। সেসব দিয়েই যেন সমস্ত ভক্তি, প্রেম, বেদনা ঈশ্বরের চরণে প্রতিনিয়ত নিবেদন। সাধুবাবার কথা প্রসঙ্গে আমরা মোহরের ঈশ্বর-বিশ্বাস বা আধ্যাত্মিক বোধের কথা বেশি করে জানতে পারি। কিন্তু আজন্ম তিনি যে দর্শনকে লালন করেছেন তা যেন বরাবরই ধূপগন্ধী।
“ঈশ্বর যখন যা দিয়েছেন নিয়েছি। কখনও প্রত্যাখ্যান করিনি৷ এখন যখন তিনি এই রোগ দিলেন, আমি প্রত্যাখ্যান করতে চাইছি, এর থেকে মুক্তি চাইছি, এ তো ঠিক নয়। তার চেয়ে বরং যার জীবন সবে শুরু হচ্ছে এই ওষুধ তার কাজে লাগুক৷” জীবনদেবতার প্রতি এই সুবিচার ভক্তের দিক থেকে আসা প্রয়োজন বৈকি! যেন ঈশ্বর, ভক্তের পরিপূরকের সম্পর্ক। যেন, ঈশ্বরের কাছে ভক্তের নির্ভয়ে মাথা পেতে নেওয়া- আরো আঘাত সইবে আমার সইবে আমারও, আরো কঠিন সুরে জীবন-তারে ঝঙ্কারো।
____
গ্রন্থ এবং চিত্র ঋণঃ আনন্দধারা, মোহর
কৃতজ্ঞতাঃ শ্যামশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বাতী ভট্টাচার্য, পূর্ণেন্দু ভট্টাচার্য।