কালো পিঁপড়ে

কারোর মুখ ভোরের দিকে মনে পড়ে, কারোর মুখ সূর্যাস্তের ঠিক আগে। কারোর মুখ কোনওদিনই মনে পড়ে না।
এগারো বছর আগেকার এক সন্ধ্যার সে মুখ রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।
সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি, রাত্রি পেরিয়ে পরদিন ভোর। ব্যস।
বিকেল থেকেই থমথম করছিল চারপাশ। আকাশ মেঘে মেঘে টাইট। একটু পরে যেন শিশুর হাতের শস্তা কালারবক্স ফেটে আকাশকে একেবারে মর্মান্তিকভাবে রক্তাক্ত করে দিল। গাছের পাতা নড়ছে না। গাছেরা নুয়ে পড়ছে না হাওয়ায়। কেননা হাওয়া নেই। আশপাশের কালচে বাড়িগুলো ভয়ে মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
যুদ্ধ পরিস্থিতি।
সওয়া ছটার একটু পরেই হাওয়া উঠল। ষাঁড়ের মতো বেপরোয়া হাওয়া। হঠাৎ তাড়া খেয়ে পথের ধুলো, গাছের ধুলো, বাড়ির কার্নিশের ধুলো যেন প্রাণ হাতে করে পালাতে লাগল। সেসময় এই কাঠের বার্নিশ উঠে যাওয়া একতলা বাড়িটাতে ছেলেটি একাই থাকত। কড়্কড়্ করে বাজ পড়ল।
বিদ্যুৎ।
বৃষ্টি শুরু হল।
সেই তুমুল দুর্যোগের মধ্যে মেয়েটি বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল। মূহুর্মূহু ধাক্কা দিতে লাগল দরজায়।
‘কেউ আছেন, কেউ আছেন, খুলুন না প্লিজ...’ – দরজা খুলে যেতেই বজ্রবিদ্যুৎবৃষ্টি নিয়ে মেয়েটি হুড়মুড় করে দৌড়ে ঢুকে পড়ল। ফিকে গোলাপি সালোয়ার-কামিজ জলে ভিজে একসা হয়ে গেছে। মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘তিনটে লোক, বিশ্বাস করুন, তিনটে লোক আমার জন্যে সারা শহর হন্যে হয়ে চষে বেড়াচ্ছে। আজকের রাতটা...’
‘সম্ভব না।’ ছেলেটি বলল।
‘খুঁজে পেলে আমায় শেষ করে দেবে।’
‘তা কী করে হয়?’
‘ওরা খুঁজতে খুঁজতে এই অঞ্চলে ঢুকেছে। এই বাসট্যান্ডে দেখা গেছে ওদের।’
‘তাতে কী?’
‘আপনার এত বড় বাড়ি। একা থাকেন। যদি রাতটা কোনওমতে...। কাল ভোরের আগেই ওরা ফিরে যাবে।’
‘কিন্তু ওরা যদি ফলো করে থাকে আপনাকে? যদি...’
‘ওরা আমায় দেখতেই পায়নি। কথা দিলাম।’
পুরনো, কিন্তু বাড়িটা বেশ বড়। ছেলেটি ভেবে দেখল যে-কোনও ঘরেই মেয়েটিকে থাকতে দেওয়া যায়। একটামাত্র রাত তো! একটামাত্র প্রাণ তো! ছেলেটি পশ্চিমদিকের শেষ ঘরটার দরজা খুলে দিল। ঘরটা মাঝারি সাইজের। মেয়েটি বারবার করে জানলা খুলতে মানা করল। ঘরের মাঝ বরাবর একটি চৌকি, তার ওপর মেকশিফট বিছানা পাতা। দেয়ালে একটা আধছেঁড়া ক্যালেন্ডার। ২০১২-র। এককোণে একটা কাঠের টেবিল-চেয়ার। শেডওয়ালা টেবিলল্যাম্প। পেডেস্টাল ফ্যান। চৌকির মাথার কাছে একটা কাচের গ্লাস।
ছেলেটি বলল, ‘চান তো বাথরুমে গিয়ে আমার একটা শার্ট গলিয়ে আসতে পারেন। এছাড়া তো আর কোনও...’ ‘থ্যাঙ্কস’, মেয়েটি বলল।
সব রেডি হয়ে যাবার পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে, ছেলেটির হঠাৎ নজরে এল বিছানার ঠিক পাশে মেঝেতে বেশ বড় সাইজের এক টুকরো খাবার পড়ে থাকবে বোধহয়, একদল কালো পিঁপড়ে বিছানার দিক থেকে সার বেঁধে সেই দিকে চলেছে।
‘ও কিছু না, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। ওরা থাকুক, ভারি তো পিঁপড়ে তার আবার কালো!’ মেয়েটি বলল।
পাশের ঘরে শুয়ে শুয়ে সারা রাত চোখের পাতা এক হল না ছেলেটির। মেয়েটি আসলে কে, জিজ্ঞেস করা হল না। কোথা থেকে এসেছে? যাবেই বা কোথায়? কবে? ওই তিনজন লোক আসলে কারা? কেন তারা শহর পাড়া বাসস্ট্যান্ড চষে ফেলছে?
বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু সারারাত আকাশ বাজ আর বিদ্যুৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। এখন কিছুটা শান্ত। মেয়েটি কি সত্যিই বিপদে পড়েছে? কিন্তু মেয়েটি বেশ প্রাণচঞ্চল, ছেলেটি ভাবল, আর সাহসী।
মেয়েটির ঘরে আলো অনেকক্ষণ নিভে গেছে। ছেলেটির ঘুম এল না। কেউ যেন এসে দাঁড়াল না তার দরজার কাছে, আচম্বিতে? কই না তো। সিঁড়ির নিচে ভারী কিছু একটা গড়িয়ে যাবার শব্দ? হবেও বা। বাথরুমের লাইট জ্বলে উঠল না হঠাৎ? নিভেও গেল। ও ঘর থেকে গুমরে গুমরে ওঠা কান্নার শব্দ না?
কিছু না। ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেটি দেখল কিচ্ছু না। আসলে কিছুই হয়নি সারারাত। আকাশ পোষ মেনে এসেছে শুধু। মেঘগুলি আর নেই।
হালকা ঠেলা দিতে খুলে গেল মেয়েটির ঘরের পাল্লা। প্রথম কাকভোরের ছোঁয়াচ লাগা নিস্তরঙ্গ ঘর। বিছানা। মেয়েটি খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়।
কালো পিঁপড়ের দল সার বেঁধে খাবারের টুকরো ছেড়ে এবার এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটির দিকে।