সন্তানের মা

কলিকাতা- শ্রীপাট কালি নামের আদি থান। ‘জোব’ নামা ফিরিঙ্গির আগমন কালেও এ থানের লোক নাম ছিল ‘কালী ক্ষেত্র’। আর নয়ই বা কেন। বড়িশা চৌধুরীদের সাবর্ণ গোত্রে কালীঘাটের এক পাথুরে কালী নামেই কলিকাতা-র মহিমা কীর্তন হয়। ফিরিঙ্গীও সেলাম দিত তাঁকে। প্রবচন ওঠে ‘কালীক্ষেত্র দীপিকা’। তাই মায়ের পুজো রোজের ধুম পায়। আর পাঁজি লিখিত কার্তিকের অমাবস্যায় মায়ের এক সালের মহা বৈভব।

ওদিকে অমাবস্যার নিশেনে রাত নিশুতি হয়। সূয্যি পাটে গেলে চাঁদ তারারাও মুখ লুকোয়। আজ ওদের দেখা মেলা ভার। আকাশও কালি মাখে সারা শরীর জুড়ে। অন্ধকারের এমন দিশা মেলা ভার। মায়ের পুজো লাগে। বাচস্পতি বচনে ভূত চতুর্দশীও পালন হল। ওনারা সব আসেন মা নামের পূর্ব দিনে। অমাবস্যা নিশেন দিলেই ওরা রওনা হন দল বেঁধে। কেউ বাঁশ বনে, কেউ তেঁতুল তলায়, কেউ তেপান্তরে কেউবা আবার ছাদের আলসেতে।একদিকে ঠাকুমা কচি-কাচাদের শেখাতে থাকেন ‘ভূত আমার পুত/ পেত্নী আমার ঝি/ রাম লক্ষণ বুকে আছে/ করবি আমার কি/। কিন্তু এ যাত্রায় ওঁরা কিছু করতে আসেন না।ওঁরা ওদের আদরের জনদের দেখতে আসেন। আর তাই ওঁদের ফেরার রাস্তাকে আলো দিতে আকাশ পিদিম ওঠায় বাড়ির কর্তারা। কেউ দেয় বিলাসী ফানুস।
দস্যু নিবারণের পর মায়ের হাসি দেখ না। মায়ের মুখেই আজ জগৎ জোড়া আলোর দিশা। নিজের রাগকে আগুন বানিয়ে শরীরটাকে কালি করলে সে। কিন্তু তাতেও আলোর নাচন বাঁধ মানে না। জটাধারী শবাসনে বউয়ের সেই আলোর নাচন দেখে- নিজেও মনে মনে ‘মা’ উচ্চারণ করে। শব্দ ওঠে নাভিমূল থেকে।
এ মা-কে ফিরিঙ্গিরা তুলনা দিয়ে বলতেন ‘পিয়েতা’। মাদাম মেরি যখন মৃত পুত্র যীশুকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন সেই রূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা করুণা, পিয়েতায় রূপ বদল করে। ঠিক যেন তারই মত এ বঙ্গের কালীমাতা শ্মশান-মশানে জেগে থাকেন সন্তানদের জন্য। তাঁর কত সন্তান দেহ রেখেছে। তাদের কোল দেবে কে? এই চিন্তায় মায়ের ঘুম নেই। সুখের কৈলাস ছেড়ে মা বেছে নিলেন এক অন্য রকম বাসস্থান। তাই আজও কোনও বাড়ির কলের গানে জ্ঞান গোঁসাই গেয়ে ওঠেন –‘সন্তানে দিতে কোল ছাড়ি সুখ কৈলাস...’। এমনি অনুভব করেছিলেন আমাদের আদুরে কবি দুখু মিঞা। দেওয়ালের পিদিমে তেল পরে, সলতে পাকায় মেয়ে-বউ’রা।