সুইস আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসবের মঞ্চে ইতিহাস গড়লো কালিম্পং-এর স্কুল

উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি শহর কালিম্পংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থিত কুমুদিনী হোমস উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়টির (Kumudini Homes Higher Secondary School) নাম ভারত তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই হয়তো শোনেননি। সময় পাল্টেছে। শীঘ্রই অজ্ঞাতবাস ঘুচতে চলেছে কুমুদিনী হোমস-এর। ১৫ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বিশ্বের সামরিক ব্যান্ডগুলিকে নিয়ে আয়োজিত হল ‘বাসেল ট্যাটু’-র বার্ষিক সংগীতানুষ্ঠান। প্রথমবারের মতো, এই অনুষ্ঠানে ভারত থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নিয়েছে কালিম্পং-এর কুমুদিনী হোমস স্কুলের ২১ জন ছাত্রের একটি গানের দল বা ব্যান্ড ‘পাইপস অ্যান্ড ড্রামস’ (Pipes and Drums Band)। এই প্রথম কোনো সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাঁদের সংগীত নিয়ে হাজির হলো আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে।
ড্রাম, পাইপ এবং অন্যান্য যন্ত্রসঙ্গীতের একটি সামরিক রূপ হল ট্যাটু। জনপ্রিয়তার নিরিখে বিখ্যাত রয়্যাল এডিনবার্গ মিলিটারি ট্যাটুর পরেই আসে বাসেল ট্যাটুর (Basel Tattoo) নাম। এবছর সুইস ফেডারেল প্রতিরক্ষা বিভাগের (Swiss Federal Department of Defense) আমন্ত্রণে বাসেল ট্যাটুর ১৫তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছে কালিম্পং-এর একমাত্র স্কুল ব্যান্ড কুমুদিনী হোমস।
বাসেল ট্যাটু প্রাথমিকস্তরে আন্তর্জাতিক সামরিক ব্যান্ড, জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এবং ট্যাটু গঠনের জন্য অন্যতম মঞ্চ। ২০০৬ সাল থেকে, বাসেল ট্যাটু বাসেল কাসারনে (পুরোনো ব্যারাক, বর্তমানে বাসেল ট্যাটু এরিনা নামেও পরিচিত) বার্ষিক ‘স্টেজ-অ্যারেনা পারফরম্যান্স’- এর আয়োজন করছে এবং এবছর জুলাই মাসেই দুটি প্যারেডের আয়োজন করেছে এই সংস্থা। বাসেল ট্যাটু প্যারেডে, আনুমানিক ১২৫,০০০ জন দর্শক সমাবেশ ঘটে, যা বিশ্বের বৃহত্তম অনুষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি দেয় একে। কালিম্পং-এর স্কুল ব্যান্ডের পরামর্শদাতা এবং শিক্ষক প্রিয়দর্শী লামা (Priyadarshi Lama) বলেন, “...এই অনুষ্ঠানের (বাসেলের) শ্রোতারা আমাদের পরিবেশন নিয়ে খুবই উৎসাহ প্রকাশ করেন। এমনকি, আমাদের জানানো হয় যে আমরা বাসেল ট্যাটুতে শীর্ষ তিনটি ব্যান্ডের মধ্যে একটি।”
যন্ত্র নিম্নমানের হওয়া সত্ত্বেও অপরিমেয় দক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করে তারা। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গোর্খা সুরের মায়াজাল বোনে ভারতীয় সামরিক সংগীত স্কুলের ছাত্ররা। ব্যাগপাইপ গঠনের পাশাপাশি, ব্যান্ডটি বিখ্যাত 'খুকরি নাচ'ও পরিবেশন করে।
সমাজের পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের জন্য এবং স্কুলের অভাব পূরণ করতে, বিখ্যাত এই শহরের অন্যতম প্রাচীন ও খ্যাতনামা সরকারি বিদ্যালয় কুমুদিনী হোমস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৪০-এর দশকে। কালিম্পং-এর প্রাচীনতম এবং প্রথম সারির সরকারি স্কুলগুলির মধ্যে একটি, কুমুদিনী হোমস। ব্রিটিশদের হাত ধরে পার্বত্য অঞ্চলে মিলিটারি ব্যান্ড মিউজিক চালু হয় এবং কুমুদিনীই সেইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি যেখানে ছাত্ররা ১৯৬০-এর দশকে ‘ব্যান্ড’ ঘরানার সংগীতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। ডক্টর গ্রাহাম হোমস (Dr Graham’s Homes) সহ অন্যান্য স্কুলগুলি পরে এই লড়াইয়ে যোগ দেয়। এখন অবশ্য কালিম্পং শহরের (Kalimpong town) অধিকাংশ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েরই নিজস্ব সামরিক ব্যান্ড রয়েছে। যদিও, পরিমিত তহবিলের অভাবে প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে জীর্ণ অবস্থায় পড়েছিল কুমুদিনী হোমস ব্যান্ডটির বাদ্যযন্ত্রগুলি। ফলে নিষ্ক্রিয় হয়ে ছিল ব্যান্ডটিও।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কুমুদিনী হোমস-এর বাণিজ্য বিভাগে যোগদান করেন প্রিয়দর্শী লামা। প্রথম থেকেই এই তরুণ শিক্ষক ছিলেন উদ্যমী। তাঁর আগ্রহ এবং গঠনমূলক উৎসাহ ছাত্রদেরও প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করে। শুধু একজন শিক্ষকই নন ছাত্রদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন বন্ধু, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক। যেকোনো বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেই এগিয়ে যেতেন প্রিয়দর্শী। তাঁর এই সহজাত ভালোবাসা এবং সমর্থন খুব তাড়াতাড়ি ছাত্রদের মন জয় করে নেয়। কিছুদিনের মধ্যেই, হ্যামলিনের পাইড পাইপারের মতো, তিনিও তাঁর ছাত্রদের নিয়ে চলে যান মিউজিক রুমে। জমে থাকা ধুলোবালি সরিয়ে শীঘ্রই বের করা হয় ড্রামস এবং থ্রেডবেয়ার পাইপগুলি। শুরু হয় সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ।
প্রিয়দর্শীবাবুর কথায়, “আমাদের ছাত্ররা প্রথম থেকেই এই ব্যান্ড নিয়ে খুবই উৎসাহী ছিল, তাই দ্রুত রপ্ত করে নিয়েছিল বাজানোর ধরন। রবিবার এবং সরকারি ছুটির দিনগুলো তো বটেই এমনকি স্কুল থাকলেও ছুটির পরে নিয়মিত অধ্যবসায়ের সঙ্গে তারা অনুশীলন করতো বাজানোর কৌশল। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। আজও আমাদের এ অভ্যাসে কোনো ছুটি নেই। অনুশীলনের সময়ও নির্ধারিত ছিল দুপুর সাড়ে ৩টে থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত।”
২০১৪ সালে, কালিম্পং এর এই স্কুল ব্যান্ডটি ব্যাসেল ট্যাটুর আয়োজকদের নজরে পড়ে। তবে প্রথম ডাক পায় ২০১৯ সালে। এর পরেই কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে আয়োজকরা ২ বছরের জন্য অনুষ্ঠান স্থগিত রাখতে বাধ্য হন। চলতি বছর, ব্যাসেল ট্যাটু চারটি মহাদেশের প্রায় এক হাজার অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে আয়োজন করেছে এই অনুষ্ঠান, যার মধ্যে ‘ব্যান্ড অফ হার ম্যাজেস্টিস ওয়েলশ গার্ডস’ও রয়েছে৷ কাসারনে বাসেল (সুইজারল্যান্ডের বৃহত্তম স্থানগুলির মধ্যে একটি যেখানে শত শত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং শো সারা বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়) -এর ঐতিহাসিক পটভূমিতে প্রতি গ্রীষ্মে বাসেল ট্যাটু অনুষ্ঠিত হয়। স্কটল্যান্ডে অত্যন্ত জনপ্রিয় এডিনবার্গ মিলিটারি ট্যাটুর যন্ত্রসংগীতে অনুপ্রাণিত হয়ে, স্থানীয় “টপ সিক্রেট ড্রাম কর্পস” ২০০৬ সালে শুরু করে ‘এক্সট্রাভ্যাগানজা’। এই বছরের বার্ষিকী সংস্করণে ২২টি ইউরোপীয় সামরিক ব্যান্ডের মধ্যে জায়গা পেয়েছে ভারত তথা বাংলার কুমুদিনী ব্যান্ডটি।
প্রকৃতপক্ষে প্রিয়দর্শী লামার জন্য এই সময়টা ছিল যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের। তাঁর ব্যান্ডের বেশিরভাগ সদস্যের বয়স ১৬ থেকে ২১ বছর, পাশাপাশি সকলেই প্রায় কালিম্পংয়ের গ্রামীণ এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির মানুষ। তাই তাঁদের কাছে কালিম্পং-এর ছোটো শহর থেকে সুদূর সুইজারল্যান্ড যাত্রা একেবারেই অবিশ্বাস্য ছিল। প্রিয়দর্শীবাবুর দক্ষ নেতৃত্ব এবং পরামর্শই ছাত্রদের মানসিকভাবে শান্ত করেছিল। তিনিই প্রতিটি পদক্ষেপে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছিলেন ছাত্রদের।
ব্যান্ডটি ট্যাটুতে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ পাওয়ার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে প্রশংসার ঝড় বইতে শুরু করে। “পার্বত্য অঞ্চল এই শিক্ষার্থীদের জন্য গর্বিত যারা এই আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এতদিন পাহাড়ি অঞ্চলের সেনাদের সাহসিকতাই ছিল অন্যতম পরিচিতি তবে এখন থেকে এই অঞ্চল যন্ত্রসংগীতের জন্যও পরিচিত হবে”, নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনটাই বলেছেন সহকারী অধ্যাপক, এবং দার্জিলিং-এর একটি দাতব্য সংস্থা ভিকরুন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা বিক্রম রাই। রাজ্য সরকারও অন্যান্য রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যান্ডটির তরফে।পাশাপাশি বেশকিছু বেসরকারি শুভাকাঙ্ক্ষীরাও এগিয়ে এসেছে এই উদ্যোগে।
আন্তর্জাতিক এই সফরে যাওয়ার সময় উত্তেজনায় ভরপুর হয়ে পড়ে ছাত্ররা। যন্ত্র নিম্নমানের হওয়া সত্ত্বেও অপরিমেয় দক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করে তারা। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গোর্খা সুরের মায়াজাল বোনে ভারতীয় সামরিক সংগীত স্কুলের ছাত্ররা। ব্যাগপাইপ গঠনের পাশাপাশি, ব্যান্ডটি বিখ্যাত ‘খুকরি নাচ’-ও পরিবেশন করে। সুইসরাই এই খুকরির ব্যবস্থা করে কারণ নিরাপত্তার কারণে ভারত থেকে এগুলো নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ব্যাগপাইপের সুমধুর আওয়াজ, চিত্তাকর্ষক কোরিওগ্রাফি এবং ড্রামিং, সমস্ত অনুষ্ঠানে এক রোমহর্ষক মুহূর্ত তৈরি করে।
প্রিয়দর্শী লামা আনন্দের সঙ্গে বলেন যে, সুইস নির্দেশকরা কালিম্পং-এর স্কুল ব্যান্ডটিকে দর্শকদের সামনে অসাধারণভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে সুইস আয়োজকদের তরফে বলা হয়, “এইবছর আমরা আরও ভালোভাবে অনুষ্ঠানটি উদযাপন করতে চলেছি। বাসেল ট্যাটুর ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য আমরা আয়োজন করতে চলেছি ব্যাগপাইপের উপস্থাপনা। পরিবেশন করবে ভারতের কালিম্পং-এর কুমুদিনী হোমস স্কুল পাইপস অ্যান্ড ড্রামস ব্যান্ড। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আপনারাও নিজেদেরকে ভাসিয়ে দিন প্রাচ্যের সুর, স্কটিশ শব্দ এবং হাস্যরসাত্মক সুরের আবহে।”
প্রিয়দর্শী লামা এবং তাঁর ছাত্রদের জন্য, এ ছিল নিঃসন্দেহে একটি দীর্ঘ এবং কঠিন যাত্রা। কিন্তু একটুও লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি তিনি। সযত্নে লালন করেছেন তাঁর সংগীতের প্রতি অনুরাগকে এবং তাঁর নেতৃত্ব রক্ষা করেছে তরুণদের। প্রাথমিকভাবে বলতে গেলে আজ তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে তাঁর খিদে মেটেনি একটুও। তিনি জানান, এই মাসের শেষে তাঁর ছাত্রদের নিয়ে ফিরে এসে আবার পুরোনো রুটিন শুরু করবেন তিনি। একইভাবে স্কুল ছুটির পরে ছেলেদের নিয়ে চালিয়ে যাবেন অনুশীলন। আমরাও অপেক্ষা করবো বাংলার তথা ভারতের বৃহত্তর কোনো সংগীত গৌরবের জন্য।