No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    পাল সম্রাটকে হত্যা করে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন দিব্য

    পাল সম্রাটকে হত্যা করে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন দিব্য

    Story image

    পাল সাম্রাজ্য। প্রাচীন বাংলার গৌরব। সেই বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল এক বিদ্রোহ। কেউ তাকে বলেন কৈবর্ত বিদ্রোহ, আবার কেউ কেউ বরেন্দ্র বিদ্রোহও বলে থাকেন। ধর্মপাল কিংবা দেবপালের যুগ তখন অতীত। পাটলীপুত্রের সিংহাসনে তখন দ্বিতীয় মহীপাল। যে কোনো স্বৈরশাসকের মতো এঁরও ছিল সিংহাসন হারানোর ভয়। ভাবলেন, তাঁর দুই ভাই রামপাল আর শূরপাল দখল করে নিতে পারেন রাজক্ষমতা। সুতরাং, দুই ভাইকে বন্দি করা হল কারাগারে। এরকম সময়েই কৈবর্ত বিদ্রোহের অভিঘাত আছড়ে পড়ল দ্বিতীয় মহীপালের ওপর। কিছু ইতিহাসবিদ বলেন, বিদ্রোহীরা ছিলেন সম্রাটের ভাই রামপালের সমর্থক। তবে এই মতকে মানা যায় না, কারণ, এই বিদ্রোহে রামপাল কোনোভাবেই উপকৃত হননি। বরং তিনিই এই বিদ্রোহ দমন করেছিলেন পরবর্তীকালে। বরং মহীপালের অত্যাচারই কৈবর্তদের বিদ্রোহ করতে বাধ্য করেছিল। এই মতটাই বেশি গ্রহণযোগ্য।

    কৈবর্তরা মূলত জেলে। পাল আমলে তাঁদের বাস ছিল বরেন্দ্র অঞ্চল বা বৃহত্তর দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, রাজশাহী ও বগুড়া জেলা জুড়ে। সেখানে নদীনালার সংখ্যা কম। তাই, বহু কৈবর্ত ওই সময়ে কৃষিকাজকেই পেশা হিসেবেই বেছে নিয়েছিলেন। তখন পাল সাম্রাজ্য ছিল দুর্বল। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছেন বর্মণ রাজারা। পাল রাজবংশও ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করে নানান সমস্যায় জর্জরিত। এরকম পরিস্থিতিতে ১০৮০ সাল নাগাদ দিব্য বা দিব্যকের নেতৃত্বে বরেন্দ্র অঞ্চলের একদল মানুষ যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। দিব্য ছিলেন পাল প্রশাসনের এক উঁচু পদের রাজকর্মচারী। প্রশাসনের সবলতা কী, দুর্বলতা কী, সব খবর তিনি রাখতেন। আর তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বেশ কিছু সামন্ত রাজা। কৈবর্ত বিদ্রোহকে তাই সামন্ত বিদ্রোহও বলা যেতে পারে। অবশ্য ইউরোপের ফিউডাল লর্ডদের মতো ভারতের সামন্তদের অবস্থা ছিল না। সে যাই হোক, নৌযুদ্ধে পারদর্শী ছিল দিব্যের সেনাবাহিনী। দিব্য ও তাঁর বাহিনীকে ঠেকানোর জন্য যুদ্ধ গেলেন দ্বিতীয় মহীপাল। কিন্তু যুদ্ধে মৃত্যু হল তাঁর। আর দিব্য তৈরি করলেন বরেন্দ্র অঞ্চলে তাঁর স্বাধীন রাজ্য। বর্মণ রাজা জাতবর্মার সঙ্গেও দিব্যের যুদ্ধ হয়েছিল। তবে বরেন্দ্র রাজ্যের তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। এই কারণে বলা হয়, কৈবর্ত বিদ্রোহ ছিল বাংলার প্রথম সফল বিদ্রোহ।

    দ্বিতীয় মহীপালের পর পাল সিংহাসনে বসেছিলেন শূরপাল। তবে বেশিদিন তিনি রাজত্ব করতে পারেননি। পরবর্তী সম্রাট হন রামপাল। তিনি বেশ কয়েকবার দিব্যকে আক্রমণ করে বরেন্দ্রতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। বরং দিব্যই বারবার পাল সাম্রাজ্য আক্রমণ করে রামপালকে ব্যতিব্যস্ত করতেন। দিব্য মারা গেলে তাঁর ভাই রুদোক বরেন্দ্রর রাজা হলেন। তাঁর আমলে বরেন্দ্র রাজ্য আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রুদোকের পরে তাঁর ছেলে ভীম রাজা হন। তিনিও ছিলেন যথেষ্ঠ পরাক্রমশালী এবং জনপ্রিয়। এদিকে রামপাল বরেন্দ্রকে আবার ফিরে পাওয়ার সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দুর্বল হয়ে পড়া পাল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা অর্ধেক স্বাধীন কিংবা পুরো স্বাধীন সামন্তদের তিনি প্রচুর অর্থ আর জমি দিয়ে নিজের পক্ষে টানতে থাকেন। মামা মথনের সাহায্য নিয়ে সামন্তদের সঙ্গে করে তারপর রামপাল বরেন্দ্র আক্রমণ করলেন। মথন ছিলেন দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূট বংশের সন্তান।

    এবারের যুদ্ধে বরেন্দ্রর সৈন্যরা খুব একটা সুবিধে করতে পারল না। সবে তৈরি হওয়া রাজ্যের সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল রামপালের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে। ১০৮২ সাল। গঙ্গার উত্তর তীরে যুদ্ধ করতে গিয়ে বন্দি হলেন ভীম। রামপালের সেনারা ভীমের রাজকোষ লুঠ করে নিল। এরকম অবস্থায় রাজা ভীমের বিশ্বস্ত বন্ধু হরি আবার নতুন করে সব পরাজিত সৈন্যদের একত্রিত করলেন, আর তাদের দিয়ে রামপালের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়ালেন। কিন্তু রামপালের ছিল প্রচণ্ড কূটনৈতিক ধূর্ততা। প্রচুর সোনার মোহর খরচ করে শেষ পর্যন্ত তিনি হাত করে ফেললেন হরি আর তাঁর সৈন্যদলকে। তারপর ভীমের পরিবারকে মারা হল ভীমের সামনেই। ভীমকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হল। যাতে আর কেউ বিদ্রোহ করার সাহস না দেখাতে পারে, তার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হল ভীমের অনুচরদের। বরেন্দ্র আবার পাল সাম্রাজ্যের অধীনে ফিরে গেল।

    (ওপরের ছবিটি বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায় অবস্থিত দিবর স্তম্ভ বা দিব্যক জয়স্তম্ভের দৃশ্য। জনশ্রুতি আছে যে দিব্য অথবা তাঁর ভাইপো ভীম এই স্তম্ভ তৈরি করিয়েছিলেন। এই স্তম্ভটি কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মৃতি।)

    তথ্যসূত্র – বাংলাদেশের ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার; বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @