কাগ্রামের জগদ্ধাত্রীপুজো

বাংলার হৈমন্তিক দুর্গোৎসব জগদ্ধাত্রীপুজো। কৃষ্ণনগর চন্দননগর প্রভৃতি জনপদের জগদ্ধাত্রীপুজো বনেদিয়ানায়, প্রতিমা প্রদর্শনে, প্যান্ডেলে, আলোকসজ্জার সৌকর্যে, থিমের অভিনবত্বে মহানগরীর শারদোৎসবের প্রতিস্পর্ধী। এদিকে গ্রামীণ ঐতিহ্য, সাবেকিয়ানার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধনে ও জাঁকজমক আড়ম্বরে মুর্শিদাবাদ জেলার সালার থানার কাগ্রামের জগদ্ধাত্রীপুজো ধারে ও ভারে কোনও অংশে কম নয়। পারিবারিক ও সর্বজনীন মিলিয়ে ২২টি জগদ্ধাত্রী পুজো হয় কাগ্রামে। লক্ষাধিক জনসমাগম, আলো, বাজনা, মেলা, শোভাযাত্রা, রাতভোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জেলা তো বটেই, রাজ্যে অন্যতম নজরকাড়া লোক - উৎসব কাগ্রামের জগদ্ধাত্রীপুজো।

কাগ্রাম ২২ পাড়ার বৃহৎ জনপদ। জনসংখ্যা হাজার বিশেকেরও বেশি। পূর্বতন নাম কঙ্কগ্রাম। সেনবংশের রাজা লক্ষণ সেনের শক্তিপুর তাম্রশাসনে দেখা যায় এই গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল কঙ্কগ্রামভুক্তি নামে বিশেষ বঙ্গীয় অঞ্চল। গ্রাম্যদেবী কঙ্কচণ্ডী। একাধিক প্রাচীন প্রস্তরবিগ্রহ সহ টেরাকোটা অলঙ্করণ সমৃদ্ধ জোড়া রেখদেউল অন্যতম পুরাকীর্তি। একসময় গ্রামে ওলন্দাজদের বাণিজ্যিক কুঠি ছিল। বারমাসে তেরো পার্বণ তো লেগেই আছে। কিন্তু কাগ্রামের জগদ্ধাত্রীপুজো মানেই এক জমজমাট শারদোৎসব। যারা বছরভর বাইরে থাকেন পুজোর টানে বাড়ি ফেরেন। শুরু হয় পুজোর কেনাকাটা। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরাও সক্রিয় ভাবে পুজোয় থাকেন জুড়ে। পুজোপলক্ষে দু পক্ষের অত্মীয়-স্বজনের ঘটে সমাগম।

কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্ভবের কিংবদন্তীতে জড়িয়ে আছে চন্দননগরের মতোই। অর্থাৎ সেই কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি ও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। অনেকেই মনে করেন আনুমানিক ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়। কথিত আছে চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরি রাজবাড়ির পুজো দেখে উৎসাহিত হয়ে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো এনেছিলেন। অন্যদিকে কাগ্রামের সম্ভ্রান্ত মাশাই অর্থাৎ মহাশয়বংশের পূর্বপুরুষ ছিলেন কৃতবিদ্য পণ্ডিত নন্দলাল বিদ্যাভূষণ। আদিনিবাস ছিল কেতুগ্রামের নিরোল ধাঁধোলসা গ্রামে। জনশ্রুতি - কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন এই বিদ্যাভূষণ মহাশয় বা এই বংশের অন্য কোন সারস্বত ব্যক্তিত্ব।
সম্ভ্রান্ত "মহাশয়" উপাধি সম্ভবত কৃষ্ণনগর রাজসভা থেকেই পেয়েছিলেন। শিক্ষক গবেষক বরুণ সাহা, বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা পঙ্কজ সাহাদের মতে এই বংশের সারদাভূষণ তস্য কনিষ্ঠ ভ্রাতা ত্রৈলোক্যনাথ এবং ভ্রাতুষ্পুত্র নীলরতন মহাশয় কাগ্রামে জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলন করেন। অনেকেই আবার বলেন - মাশাই বাড়ির গৃহবধূ সারদাসুন্দরী দেবী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মাতৃপুজো প্রচলন করেন। আজও পুজো হয় জাঁকজমকে ও সাবেকিয়ানায়। পুজোর দিন মোষ বলি হয়। রয়েছে কুমারী পুজো। রীতি মেনে সপ্তমী আষ্টমীর আলাদা আলাদা ভোগ। অনেকে আবার বলেন উত্তরপাড়ার ব্যানার্জী বাড়ির বুড়িমা নাকি আরও প্রাচীন। এই পুজো আগে হতো নদিয়া জেলার বেলপুকুর গ্রামে। মূর্তির দুপাশে রয়েছে জয়া বিজয়া।
কাগ্রামের জমিদার ছিল ডাকসাইটে চৌধুরী বংশ। ব্রহ্মপদ রায়চৌধুরীর জমিদারি ছিল নয় আনা। এদের পারিবারিক জগদ্ধাত্রী প্রায় ১৩৯ বছরের পুরাতন। জমিদার সুরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর মাতা রাধারানিদেবীর সময় থেকে পুজো চলে আসছে। এই বংশের কুলদেবী ছিলেন কষ্ঠিপাথরের মা তারা। অমূল্যমূর্তিটি কয়েক বছর আগে চুরি হয়ে গেছে। সাত আনার জমিদারি জগদ্ধাত্রী আসছেন প্রায় ১২১ বছর ধরে। জমিদার রক্ষাকর রায় চৌধুরীদের জগদ্ধাত্রী আনেন ১৩২১ সনে। শোভাযাত্রা ছিল দেখার মতো। মাশাই বাড়ির সঙ্গে জমিদার বাড়ির প্রতিদ্বন্দ্বিতা আজও কিংবদন্তী। এছাড়া পারিবারিক পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম দেবাড়ির পুজো, মিস্ত্রিবাড়ির পুজো, ঘটকপাড়ার ব্যানার্জিবাড়ির পুজো, পালবাড়ির পুজো, গোপেশ্বর ব্যানার্জির পিলেউলি পুজো শিবনারায়ণ সাহার পুজো ইত্য্যাদি। বারোয়ারি পুজোগুলিও কম আকর্ষণীয় নয়। দক্ষিণপাড়ার সর্বজনীন, সাহাপাড়ার সর্বজনীন, তাঁতিপাড়ার বারোয়ারি, উত্তরপাড়ার বাজারপাড়া বেদেডাঙা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রায়েরপাড়া সর্বজনীন পুজোটি যথেষ্ট প্রাচীন। এটি আগে পারিবারিক পুজো ছিল। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শম্ভুনাথ রায়। এখানে পুজোর সংকল্প হয় মহিলাদের নামে। কোথাও প্রাচীন ঐতিহ্যের হাতছানি। কোথাও বা থিমের পুজো।

কাগ্রামের জগদ্ধাত্রীপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য "দুপুরে মাতান" অনুষ্ঠান। অষ্টমীর পুজো শেষে প্রতিটি পুজোকমিটির দেওয়া সাদাধুতির পাগড়ি মাথায় বাঁধে বাজনদাররা। দেবীর চরণের সিঁদুর কপালে টেনে এবার শুরু হয় বাজনা আর নাচ। সেই সঙ্গে গ্রামপরিক্রমা। ব্যান্ড তাসা ব্যঞ্জো ঢাক ঢোল ডগর ক্যাসিও ইত্যাদি নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে তোলপাড় করা গ্রামপরিক্রমা। দুপুরে মাতান দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় করে। পুজোর দুটো দিন গ্রামের অলি গলি রঙ-বাহারি আলোয় সেজে ওঠে। বসে পুলিশ ক্যাম্প মেডিকেল টিম। বিভিন্ন পুজো কমিটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনি গঠন করে। রাতভর চলে উদ্দাম নাচ গান অর্কেষ্ট্রা। আগে বাউল যাত্রাগান কবিগান বাউলগানে মুখরিত হত পুজোপ্যান্ডেলগুলি। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে। দশমীর রাতে শোভাযাত্রায় অজস্র জনসমাগম ঘটে। সারারাত গ্রাম পরিক্রমার পর সকালে দেবীর নিরঞ্জন।
ছবিঃ বরুণ সাহা পঙ্কজ সাহা।।