কালিম্পং-এর কাগে : পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটি গ্রাম

রাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘা
পাহাড়ে এলে যত ঠান্ডাই থাক, খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। তখন আর বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। অতএব মুখ ধুয়ে প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়ে বাইরে আসি।
গতকালই এক মিষ্টি সকালে, পেডং থেকে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম কাগে-তে এসেছি। ব্রেকফাস্ট সেরেছিলাম পেডং-এ, পূর্ণ তামাংয়ের ওখানে। সেই সময় তো বটেই, আজও উত্তরবঙ্গের বহু মানুষ কাগের নাম জানে না। আমি বরাবরই অচেনা ও প্রত্যন্ত অঞ্চল খুঁজে নিয়ে বেড়াতে আসি। এ ব্যাপারে খুব বেশি সাহায্য পেয়েছি পূর্ণজির কাছে। কাগেও তাঁর সূত্রেই আসা। কালিম্পং জেলার অন্তর্গত পেডং বেশ জমজমাট এক জনপদ। সেখান থেকে মাত্র আধঘণ্টার দূরত্বে কাগে, নির্জন ও শান্ত এক গ্রাম।
কাগে (Kagey) নিয়ে বিস্তারে যাওয়ার আগে সেই অপূর্ব প্রভাতের কথা। ঘরের বাইরে একটি পাথরের চাতাল। সেটিকে রঙ্গিন ছাতা, চেয়ার ইত্যাদি দিয়ে বেশ সুন্দর বসার জায়গা বানিয়ে দিয়েছেন এঁরা। যেন একটি প্রাকৃতিক ব্যালকনি। সেখানেই বসে একটু একটু করে একটি দিনের জন্ম প্রত্যক্ষ করছি। পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। এদিক ওদিক চাইতে হঠাৎই চোখ যায় দূরে। বেশ অনেকটা দূর। তবু স্পষ্ট সেই অনির্বচনীয় তুষার-ধবল চূড়া। কাঞ্চনজঙ্ঘা? দৌড়ে আমার পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা সহযাত্রী ভাই রাজদীপকে তুলি। তারপর কেমন করে তার সাহায্যে হাচড়ে পাচড়ে অনেকটা নিচের হোমস্টে থেকে ওপরের গাড়ির রাস্তায় উঠি পাগলের মতো, শুধু আর একটু ভালো করে তেনাকে দেখবো বলে, সেটা লিখে প্রকাশ প্রায় অসম্ভব!
কালিম্পং জেলার অন্তর্গত পেডং বেশ জমজমাট এক জনপদ। সেখান থেকে মাত্র আধঘণ্টার দূরত্বে কাগে, নির্জন ও শান্ত এক গ্রাম।
ঢেউ খেলানো প্রকৃতি
চারপাশের গ্রাম তখনও ভালো করে জাগেনি। আমরা অনেকটা সময় ধরে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃপ্ত রূপ । অত দূর থেকেও স্পষ্ট তার অনতিক্রম্য আকর্ষণ! ছবিও তোলা হলো। আমার অতি সাধারণ ডিজিটাল ক্যামেরায় যতখানি ওঠে ! তবু সে যে কাঞ্চনজঙ্ঘা ! তারপর সামান্য রোদ উঠতেই অদৃশ্য তিনি। আমরা যা পেয়েছি, তাতেই পরিপূর্ণ হয়ে নেমে এলাম নিচে। এসে বসলাম ওই চাতালে। সামনে পাহাড়ের ধাপে ধাপে বোনা ফসলের ক্ষেতে তখন সকালের সোনা রোদ খেলা করছে। একটু পরেই হোমস্টে-র কর্ত্রী কফি নিয়ে এলেন আমাদের জন্য। মাত্র তিনদিনেই বুঝেছিলাম শুধু পরিবার নয়, পুরো গ্রামের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ। সবার সব সমস্যার সমাধান ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ আছে ওঁর ঝুলিতে। সদা হাস্যময়ী সেই নারীকে দেখে দারুন অনুপ্রাণিত হই, আজও মনে আছে । কাছেই একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তার সঙ্গে যাবতীয় গৃহকর্ম। গ্রামের এটা-ওটা। তারই মধ্যে আমাদের মতো অতিথিদের দেখভাল।
গতকাল যখন পৌঁছই এখানে, তখন পুরো রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে গেছে দুর্গাপুজোর উন্মাদনা। সেই সব আয়োজন, উদযাপন থেকে অনেক দূরের এই গ্রামে একটাই পুজো। পুরো গ্রাম তাতে সংপৃক্ত। আমরা যেখানটায় আছি, তার থেকে অনেকটা উঁচুতে একটি ছোট মালভুমির আকারের জমিতে পুজোর প্যান্ডেল। আমার পৌঁছনো ক্ষমতার বাইরে। রাজদীপ ঘুরেফিরে সেখানে যায়, আর, এসে আমায় ধারাবিবরণী দেয়। অর্থাৎ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তার আমোদ-আভাস পাই মাইকের মাধ্যমে। গ্রামের নৃত্যগীতিপ্রিয় মানুষের তাই নিয়েও উৎসাহ কম নয় ! প্রসাদও পৌঁছে যায় হাতে পরিবারের ক্ষুদে সদস্য মারফত। সব মিলিয়ে পুজো উপভোগের এক অমলিন অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুন: হেতমপুরের ‘হাজারদুয়ারি’
শুরুর দিনেই একেবারে দুর্দান্ত রাইশাকের স্বাদ, অনেকটা ভাত খেয়ে ফেলি শাক দিয়েই । তারপরের প্রতি লাঞ্চের মেনুতে ‘রাইশাক’ বাঁধাধরা হয়ে গেছিল। এছাড়াও চিকেনের একটি বিশুদ্ধ নেপালি ডিশ আজও মুখে লেগে আছে। কাগে পাক্কা কৃষিপ্রধান গ্রাম। আর সম্পূর্ণভাবে জৈবসার প্রয়োগের মাধ্যমে চাষ হয়। ফলে প্রতিটি শাকসবজি সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যগুণসম্পন্ন। এঁদের আবার বাড়িতেই পোলট্রি ও ডেয়ারি। পুরো ফার্মহাউস যাকে বলে। বুড়ো বয়সে গরুর খাঁটি দুধের স্বাদও নিতে হলো, অনুরোধের ঢেঁকি গিলে। এমনিতে লাঞ্চ ও ডিনারে যা মেলে, ভাত-রুটি, ডাল-সবজি-ভাজা, ডিম ও চিকেন। ব্রেকফাস্ট-এ পাওয়া যায় পুরি/রুটি-সবজি, অমলেট বা ডিম সেদ্ধ, নুডলস। সন্ধ্যায় চা বা কফির সঙ্গে স্ন্যাকস-এ পকোড়া, মোমো। মোমোর ক্ষেত্রে একটু আগাম অনুরোধ জানাতে হয়,তৈরির ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ বলে। হোমস্টে-র ঘরগুলি পরিচ্ছন্ন ও আরামদায়ক। এটাচড ও ওয়েস্টার্ন টাইপ বাথরুম। যাবতীয় পরিষেবা চমৎকার। প্রয়োজন অনুসারে গরমজলের যোগান রয়েছে।
ফুলের দেশ কাগে
পেডং থেকে কাগে যাওয়ার পথ-টি সেসময় বেশ পাথুরে ছিল। তবে, গাড়ির ঝাঁকুনি ভুলিয়ে দিয়েছিল দু’পাশের ছবির মতো দৃশ্যপট। উত্তুঙ্গ পর্বতরাশি, ছোটো ছোটো গ্রাম, প্রচুর ছোটো-বড়ো গাছ, ফসলের ক্ষেত আর ফুলের প্রাচুর্য। আর এই সবকিছুর পর হলো মুদুম। যেমন মিষ্টি নাম, তেমনই চেহারা। অক্টোবরে এই নদী ক্ষীণকায়া। তবু, পাহাড়ের নিয়মে খরস্রোতা মুদুম বয়ে চলেছে প্রবল বেগে। শুনলাম কাছেই এক বড় ঝর্না তার উৎস। ড্রাইভার ভাই এটাও বললো, বর্ষায় নাকি মুদুম একেবারে বাঁধনহারা। এই মুদুমের অববাহিকা জুড়ে যে উপত্যকা, তারই আশপাশ ঘেরা জঙ্গলের ভিতর পটে আঁকা ছবি যেন কাগে। মুদুমের ওপরের ছোট্ট ব্রিজ পার করেই আমাদের সেই হোমস্টে, তখনও পর্যন্ত একম অদ্বিতীয়ম।
সম্প্রতি পূর্ণজির কাছে শুনলাম, এখন আরও কয়েকটি হোমস্টে হয়েছে কাগে-তে। এটা ভালো। আরও কিছু পরিবারের আয়ের উৎসমুখ খুলে যাওয়া। চাষবাসের রোজগারে বছরভর পেট চলে না। সেসময় গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষার ওপরে আর স্কুল নেই। একটু উঁচু ক্লাসে পড়ার জন্য ছেলেমেয়েদের পেডং যেতে হতো। চিকিৎসা বলতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেটাও সব সময় খোলা থাকে না। অগত্যা সেই জড়িবুটি ভরসা। আর ভরসা প্রকৃতি। সেখানেই এই মানুষগুলোর যত রসদ জমা। সেখান থেকেই উজার করা প্রাপ্তি। গ্রামে রয়েছে একটি অতি প্রাচীন গির্জা ও একটি গুম্ফা। আর সেই ঝর্না। তার আশপাশের দৃশ্য অনির্বচনীয়। সব ধর্মের মানুষের অপূর্ব সহাবস্থান এই গ্রামে। সবগুলি উৎসবই পালিত হয় অনাড়ম্বর অথচ আন্তরিক আবেগের উচ্ছ্বাসে। দুর্গাপুজোতেও দেখলাম সেই ছবি।
মুদুম নদী
কালিম্পং থেকে মাত্র ২১ কিমি দূরত্বে অবস্থিত কাগে। এখান থেকে যাওয়া যায় লাভা, লোলেগাঁও, খোলাখাম, রিশপ, সিলেরি গাঁও, ঋষিখোলা। পেডংয়ের কথা তো আগেই বললাম। আর একটু দূরে গেলেই ডুয়ার্স। ট্রেকিংয়ের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয় কাগে। নেচার স্টাডির জন্যও বটে। প্রচুর বিরল জাতের গাছগাছালি রয়েছে জঙ্গলে। আর আছে পাখি ও প্রজাপতি। বন্যজন্তুর মধ্যে লেপার্ড। মোট কথা প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক ভাবে এর পর্যটন সম্ভাবনা যথেষ্ট। কিন্তু রাস্তার সমস্যায় সেই সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত হতে পারে না। হোমস্টে’র মালিক আক্ষেপ করে সেটাই বলেন। মাঝে অনেকগুলো বছর চলে গেছে। হয়তো এখন কিছুটা সুরাহা হয়েছে ওদের চাহিদাগুলির।
মর্গ্যান হাউজ ট্যুরিজম প্রপার্টি
এই অনেক বছরেও ভুলিনি সেই ছোট্ট গ্রামের কুমারী সৌন্দর্য। মুদুমের মিষ্টি গান। গ্রামের মানুষের অনাবিল আন্তরিকতা। হোমস্টে মালকিনের যত্ন। শুধু খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি নয়, গল্পে, সাহচর্যে। কি সুন্দর একটি ফুলের বাগান রচনা করেছেন বাড়িতে। আদতে জেলা কালিম্পং হলো ফুল-পাতা-অর্কিডের স্বর্গ। এই গ্রামের ঘরে ঘরে সেই সৌন্দর্য ছড়ানো। যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময় হলো অক্টোবর থেকে মার্চ। আরামদায়ক আবহাওয়া। ঝর্না ও নদীর শোভা দেখতে চাইলে বর্ষা। তবে, ধস নেমে আটকে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কাঞ্চনজঙ্ঘা সবচেয়ে ভালো দৃশ্যমান শীতে। প্রত্যন্ত অঞ্চল। তাই সঙ্গে রাখুন জরুরি ওষুধ, টি ব্যাগ, কফি, বিস্কুট, জল গরম করার ইলেকট্রিক কেটলি ও টর্চ।
হিল টপ ট্যুরিজম প্রপার্টি
কীভাবে যাবেন
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন, বাগডোগড়া এয়ারপোর্ট, শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড থেকে কালিম্পং চলে আসুন শেয়ার গাড়িতে। তেনজিং নোরগে থেকে বাসও পাবেন। কালিম্পং থেকে পেডং হয়ে কাগে। সরাসরি গাড়ি রিজার্ভ করেও আসতে পারেন। তাতে খরচ একটু বেশি পড়ে। হোমস্টে-র থাকা-খাওয়ার রেট দিনপ্রতি জনপ্রতি ১২০০ টাকা। কালিম্পং থেকে পিক আপের ব্যবস্থা করেন এঁরা। এছাড়া ট্রেকিং, লোকাল সাইট সিয়িংয়ের জন্য গাইড গ্রামে পাওয়া যায়। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ : ৯৯৩৩৬১৫৮২৮।
কোথায় থাকবেন
কাগের খুব কাছেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের মর্গ্যান হাউজ ট্যুরিজম প্রপার্টি (পূর্বতন মর্গ্যান হাউজ ট্যুরিস্ট লজ), হিল টপ ট্যুরিজম প্রপার্টি (পূর্বতন হিল টপ ট্যুরিস্ট লজ), তাশিডিং ট্যুরিজম প্রপার্টি (পূর্বতন তাশিডিং ট্যুরিস্ট লজ)। সড়কপথে দেড় ঘণ্টায় কাগে থেকে পৌঁছে যাবেন কালিম্পং।
তাশিডিং ট্যুরিজম প্রপার্টি
বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করুন –
West Bengal Tourism Development Corporation Ltd
DG Block, Sector-II, Salt Lake
Kolkata 700091
Phone: (033) 2358 5189, Fax: 2359 8292
Website: https://www.wbtdcl.com/
Email: visitwestbengal@yahoo.co.in,
mdwbtdc@gmail.com,
dgmrwbtdc@gmail.com