No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    নুব্রা থেকে একদৌড়ে লে—মাত্র ১১১ কিমি

    নুব্রা থেকে একদৌড়ে লে—মাত্র ১১১ কিমি

    Story image

    লেহ! নামটা শুনলেই মনে পড়ে চিন থেকে বণিকের দল ঘোড়ার ক্যারাভেনে সিল্ক বা মশলা নিয়ে কারাকোরাম পেরিয়ে দলে দলে হেঁটে ঢুকছে, তারপর পামীর মালভূমি পেরিয়ে চলে যাচ্ছে বাগদাদের দিকে। ওল্ড সিল্ক রুটের গুরুত্বপূর্ণ অংশে ছিল লেহ আর লাদাখ, চিনা, তিব্বতি,কাশ্মীরি, ইরাকি বণিকদের হৈ-হট্টগোলে গমগম করত রাতের সরাইখানাগুলো, আজও প্রত্যন্ত হিমালয়ের এই ছোট্ট শহরে সেই ইতিহাসের গন্ধ ভেসে আসে।

    লাদাখের কার্গিল জেলায় গিয়েছি এর আগে, কিন্তু লেহ শহরে এই প্রথমবার। প্লেনগুলো লেহ শহরে নামার আগে পুরো একটি চক্কর মারে। যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা শৃঙ্গের পরে শৃঙ্গ। তখন সবে মেঘের উপর দিয়ে সূর্য উঁকি মারছে, কিছু সোনালি রশ্মি ঠিকরে পড়ছে ধূসর ভ্যালিতে, আর সেই রুক্ষ হিমালয়ের মাঝে সবুজ স্বর্গোদ্যানের মত উঁকি মারছে লেহ শহর। একঝলক দেখে নিলাম সেই খার্দুংলাও। লেহ শহর থেকে সেই উচ্চতা দেখেই আঁতকে উঠলাম, এটা দৌড়ে উঠতে হবে!

    প্রথম দিন: লেহ শহরে নামলাম ভোর সাড়ে ছটার দিকে, উচ্চতা ৩৭০০ মিটার, নেমেই বুঝলাম মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। নেমেই চলে গেলাম শহরের একপ্রান্তে ‘ইকোলজি হোস্টেলে’। ঠিক করেছিলাম, এখানেই পুরো সময়টা থাকব। এই প্রথম ঘুরতে গিয়ে কোনো হোস্টেলে থাকা। হয়তো কোনো হোটেলেই উঠতে পারতাম, কিন্তু ট্রাভেলিং-এর জগতে হোস্টেলগুলো এক অদ্ভুত ভূমিকা পালন করে চলেছে, সেই গল্পই বলবো একে একে। সারাটা সকাল ঘুমিয়েই কাটালাম। দুপুরের দিকে উঠে বুঝলাম শরীর অনেকটাই ঝরঝরে হয়েছে, উচ্চতা আর আবহাওয়ার সঙ্গেও দ্রুত খাপ খাইয়ে নিয়েছি। হোস্টেল জুড়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়। আমি যে রুমে ছিলাম সেখানে আরো দুজন ছিল, একজন আর্জেন্টিনার বাসিন্দা, আরেকজন আমেরিকার। তিনজনে বন্ধু হয়ে যেতে খুব দেরি হয়নি। চটপট রেডি হয়ে লেহ মার্কেটে চলে গেলাম, জায়েন্টের একটি মাউন্টেন বাইক ভাড়ায় নিয়ে নিলাম কয়েকদিনের জন্য। বাইক হাতে পেয়েই চলে গেলাম লেহ থেকে দূরে সাবু নামে একটি গ্রামে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল স্টক কাংরি শৃঙ্গ। এখান থেকেই সুন্দর একটি ট্রেক শুরু হয়, কিন্তু হাঁটুর চোটের জন্য সেদিকে পা বাড়ালাম না। ফের উঠে এলাম লেহর উপরে শান্তিস্তূপায়। অভূতপূর্ব লেহ ফের চোখের সামনে ঝকমক করে উঠল। বুঝলাম, লেহতে আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছি।

    দ্বিতীয় দিন: এই দিন সকালে আমেরিকার বন্ধুটি হোস্টেল ছেড়ে চলে গেল। আমি বেরোলাম সাইকেল নিয়ে খার্দুংলার পথে। তবে খার্দুংলা অবধি নয়, তার আগেই ম্যাপ খুঁজে একটি ভ্যালি বের করেছিলাম। জায়গাটির নাম খার্দুং ফ্রগ। এখানে সাইকেল রেখে উঠে এলাম সেই নির্জন শুষ্ক ভ্যালি ধরে। এখানে আমি একা একাই উঠে এলাম প্রায় ৪৫০০ মিটার, খানিক সময় কাটিয়ে নেমে এলাম ফের লেহতে। অর্থাৎ ৪৫০০ মিটার অবধি শরীরকে অভ্যস্ত করে ফেললাম।

    তৃতীয় দিন: এদিন ঠিক করলাম খার্দুংলায় সাইকেল চালিয়ে উঠব, রাতটা উপরেই কাটাব। তাই দুপুরে বেরোলাম, ক্রমশ খার্দুং ফ্রগ, সাউথ পুল্লু পেরিয়ে ঠিক সন্ধের মুখে খার্দুংলা পোঁছলাম। কিন্তু সমস্যা হল খার্দুংলায় সেনাক্যাম্প আছে, তাই ওখানে থাকতে দেওয়া হয়না। এদিকে আমিও ইচ্ছে করেই রাতে পৌঁছেছিলাম, যাতে রাতটুকু থাকতে দেয়। কিন্তু, অনেক চেষ্টা করেও সেনা অফিসারের মন গলাতে পারলাম না, ফিরতি একটি ট্রাকে আমাকে সাইকেল সহ তুলে দেওয়া হল। তবে, ফের আমি সাউথ পুল্লুর একটু আগে নেমে আশ্রয় চাইতে গেলাম। এবারে আমায় আর ফিরিয়ে দিল না। রাতটুকু সাউথ পুল্লুতেই কাটল, এক নুব্রা নিবাসীর সঙ্গে। সেখানেও বুঝলাম দেশভাগের যন্ত্রণা। বাংলার যেমন এদিক ওদিক রয়েছে, নুব্রা আর বাল্টিস্তানেও সেরকম রয়েছে একই সংস্কৃতির মানুষরা। কিন্তু, মাঝে আছে লাইন অফ কন্ট্রোল। সাউথ পুল্লুর উচ্চতা প্রায় ৪৫০০ মিটার, ভোরেই ফের সাইকেল নিয়ে নেমে এলাম লেহতে।

    আসলে এটিই ছিল আমার দ্রুত এক্লামাইটেজশন করার পরিকল্পনা। যেহেতু খুব কম সময়ের মধ্যে আমাকে খার্দুংলার উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হত, তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে বারে বারে উপরে গিয়ে মানিয়ে নেওয়ার বদলে একটি রাত পুরোপুরি ওই উচ্চতাতেই কাটালাম। এরপরে নিচে নেমে দুদিনের রেস্টই আমায় প্রয়োজনীয় এক্লামাইটেজেশন এনে দিল। পুরোনো সোভিয়েতের আল্পাইন ক্লাইম্বাররা বা বর্তমানের বিখ্যাত ক্লাইম্বাররা এখন এই পদ্ধতিই ব্যবহার করে থাকে।

    চতুর্থ দিন: সোজা লেহতে নেমে এসে ভালো করে ঘুমোলাম। ততদিনে বাকি রুম পার্টনাররা বেরিয়ে গিয়েছে, তাদের জায়গায় এসেছে সুইডেনের এক বন্ধু। পেশায় মিউজিসিয়ান, হিমালয় ঘুরতে বেরিয়েছে। আর এসেছে অভীক লাহা। এর আগের পর্বে বলেছি যার কথা, হিমালয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে একাকী সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মাঝে এক্সপিডিশনেও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সে এসে লেহ পৌঁছেছে আর আমার সঙ্গেই আছে।

    বিকেলের দিকে ঘুরতে বেরোলাম ওল্ড লেহ টাউনের দিকে, সরু অলিগলি আর পুরোনো স্থাপত্য এখনো সেই মধ্যযুগের কথা মনে করিয়ে দেয়।

    পঞ্চম দিন: বিশেষ কিছু নয়, সারাদিন হোস্টেলেই বিশ্রাম নিলাম। বিকেলে দেখা করলাম এক পুরোনো ক্লাইম্বিং পার্টনার নুব্রা নিবাসী নমগেলের সঙ্গে। আর দেখা হল বেশ কিছু নতুন বাঙালি অ্যাডভেঞ্চারিস্টদের সঙ্গে, যারা নানা কারণে লেহতে এসেছে। আর চেখে দেখলাম নানা কাশ্মীরি স্ট্রিট ফুড।

    ষষ্ঠ দিন: এদিন আমি, অভীক লাহা আর সুইডেনের বন্ধুটি একসঙ্গে সাইকেল নিয়ে চলে গেলাম রুম্বক নামে একটি গ্রামে। সিন্ধু নদী পেরিয়ে গভীর খাদের মধ্যে দিয়ে মার্খা ভ্যালির এই প্রবেশদ্বারে পৌঁছলাম। তারপর, ফের ফিরে এলাম লেহ শহরে।

    সপ্তম দিন: আয়োজকদের সঙ্গে গাড়িতে করে খার্দুংলা পেরিয়ে পৌছলাম নুব্রা ভ্যালির তিরিথ ক্যাম্পে। বিশাল সেই ভ্যালির মাঝে একটুকরো আপেল বাগান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিরিথ ক্যাম্প। ইচ্ছে হলেই হাত বাড়িয়ে আপেল খেয়ে নিচ্ছি। বুঝলাম, আমি ছাড়াও আরো দুই বাঙালি রয়েছে ইভেন্টে, তবে তারা কেউ আর এখন পশ্চিমবঙ্গের নিবাসী নয়। সুন্দর সেই পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, ফটোশুট করছি, যতটা সম্ভব চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করছি। একবার তো ১১১ কিমি দৌড়বো ভেবে হাসি আর থামছিলই না। সত্যি! ১১১কিমি! কতটা দূর আমার বাড়ি থেকে! সেটাই ভাবছিলাম!

    দেখতে দেখতে চলে এল রেস ডে। মাত্র ৭ দিনের মধ্যেই নিজেকে প্রস্তুত করে ফেললাম ৫৪০০ মিটারে ১১১ কিমি দৌড়ের জন্য। যদিও হাঁটু ঠিক কতটা দৌড়ের জন্য সাপোর্ট দেবে তখনও জানি না।

    সন্ধে ৬টা থেকেই দৌড় শুরু হওয়ার কথা, হিমালয় বেয়ে সোজা উঠে যাওয়া, ফের নেমে যাওয়া, নুব্রা ভ্যালি থেকে এক দৌড়ে লেহ!!

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @