No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    জয়নুল আবেদিন – এক বিস্ময়ের নাম

    জয়নুল আবেদিন – এক বিস্ময়ের নাম

    Story image

    রনি অধিকারী
    জয়নুল আবেদিনের স্বপ্ন ছিল একটি সংগ্রহশালার, স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি যোগ্য শিল্পী সমাজ গড়ার। যার প্রয়োজনে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছেন চারুকলা ইন্সটিটিউট ও সোনারগাঁও লোকশিল্পের সংগ্রহশালা। তিনি নিজে এ দেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হারিয়ে যাওয়া শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তিনি ভাবতেন প্রতিনিয়ত মা, মাটি ও আমাদের সবুজ দেশের কথা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এ দেশের সুন্দর প্রতিষ্ঠায় অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন।

    শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬) চিত্রকলার মুকুটহীন সম্রাট ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী। তিনি আমাদের অহঙ্কার। বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির অহঙ্কার।

    দেশ, মাটি ও মানুষের মঙ্গলার্থে আজীবন যারা রক্তঘাম ঝরান তাদের কথা যেমনি সত্যিকার দেশপ্রেমিক কখনো ভোলেন না। তেমনি দেশপ্রেমিক চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের কথাও এ দেশবাসী কখনো ভুলবে না। কারণ, তিনি আজীবন লড়াই করে রক্ত ঝরিয়েছেন এ দেশের শিল্পচর্চার প্রতিকূল পরিবেশ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, মুক্তিযুদ্ধসহ সব অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে।

    শিল্পী জয়নুল বিশ্বযুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষের চিত্র এঁকে যেমনি বিশ্ববিবেকের সম্মুখে মাতৃভূমির করুণ দৃশ্যাবলী ফুটিয়ে তুলে আন্তর্জাতিক বলয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন; ঠিক তেমনি তিনি মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য সফর করে ফিলিস্তিনিদের শক্তি-সাহস জুগিয়েছেন তারই বলিষ্ঠ রঙতুলির আঁচড়ে আঁকা চিত্রকর্মের মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আর্ট ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চিত্রশিল্পী তৈরির তিনি যে মহৎ উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারই ফলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আজকের নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়ার চারুকলা ইন্সটিটিউটসহ অসংখ্য ছবি আঁকার প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে প্রচুর চিত্রশিল্পী, যারা আজ সারাবিশ্ব থেকে সুনাম কুড়িয়ে দেশের চিত্রশিল্পীকে আলোড়িত করে তুলেছেন। মূলত জয়নুল আবেদিনকে বলা হয় একজন সফল শিল্পাচার্য। দেশ থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করে দেশের চিত্র তথা শিল্পকর্ম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ায় তিনি অত্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়েছেন, আর এর পেছনে কাজ করেছে তার দূরদর্শিতা চিন্তাচেতনাসহ কঠোর ত্যাগ ও পরিশ্রম। চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন বিশ্বাস করতেন, জীবনবোধ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই প্রকৃত শিল্প সৃষ্টি হয়। তার বিশ্বাস, যে রীতিতেই শিল্পকলা নির্মিত হোক না কেন, তার সৃজনশীলতা থাকতে হবে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসহ সমাজ সংসার, পরিবেশ কিংবা পরিম-লের সঙ্গে। জয়নুল মানবতার শিল্পী। সব মানুষই সমানভাবে তার শিল্পকর্মের রস আহরণ করতে পেরেছে এবং পারে। সমাজে অবহেলিত চাষী, মজুর, জেলে, মাঝি, গাড়োয়ান, সাঁওতাল কন্যা, বেদেনী, মা ইত্যাদি শিরোনামে তার শিল্পকর্মের মুখ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।

     

    জয়নুল আবেদিনের আঁকা চিত্রগুলো যেন তাঁর দিনলিপি। তিনি যা কিছু অবলোকন করেছেন তারই প্রতিচিত্র হয়ে ধরা পড়েছে তার কাগজ-ক্যানভাসের চিত্রকলার জনজীবনের সঙ্গে। যাদের একাত্মতা আছে, আঁকার বিষয় তাদের কখনো খুঁজতে হয় না, যেমন জয়নুলের খুঁজতে হয়নি। নবান্ন, জলোচ্ছ্বাস, মুক্তিযুদ্ধ, ঘাটের পথে গাঁয়ের বধূরা, ম্যাডোনা-১৩৫০, মইটানা, গুনটানা, ঝড়, বিদ্রোহী, মনপুরা-৭০, সাঁওতাল কন্যা, মাছ ধরে ঘরে ফেরার মতো ছবিগুলো এ কথা প্রমাণ করে। নিজের প্রকৃতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিল রেখে ছবি আঁকতে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। বিদেশি আঙ্গিক গ্রহণ তার কাছে দূষণীয় ছিল না, তবে বিদেশি আঙ্গিকের সঙ্গে শিল্পীর কাছে মেধা, মনন ও আবেগ মিশিয়ে দেশীয়করণেই তার ঝোঁক ছিল প্রবল।

    সুকর্ম থেকে শিল্পকলার জন্ম হওয়ার কারণে শিল্পী হন সুন্দরের পূজারি। জয়নুল আবেদিন এ বোধ দ্বারা চালিত হয়ে, শিল্পচর্চার মাধ্যমে তিনি নিজেকে যেমনি সুন্দর করে তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তেমনি চেয়েছিলেন শিল্পীর পারিপার্শ্বিক জগৎ ও তার মানুষকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে। জয়নুলের এই সৌন্দর্যবোধই তাকে প্রকৃতিপ্রেমিক, মানবিক ও দেশপ্রেমিক তৈরিতে সাহায্য করেছিল। তিনি প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ছবি এঁকেছেন। তিনি ছবি এঁকেছেন প্রকৃতির সৌন্দর্যকে তুলে ধরার জন্য, জীবনে যা সুন্দর এবং জীবনে যা সুন্দর নয় তাকেও দেখার জন্য। জীবনে সুন্দরের যে শক্তি বিরোধিতা করে তাকেও চিহ্নিত করার জন্য। যে ছবি মানুষকে সুন্দরের দিকে নিয়ে যেতে পারে, সেটাই হচ্ছে মহৎ ছবি। আর সেই শিল্পীই হচ্ছেন মহৎ শিল্পী।

    জয়নুল আবেদিন নিজে ছবি এঁকে যতটা আনন্দ পেতেন, তার চেয়ে বেশি আনন্দ পেতেন শিল্পকে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে দেখে, নিজের শিল্পকর্মকে জীবনে প্রবিষ্ট হতে দেখে। ১৯৩৮ সালে জাতীয় চিত্রপ্রদর্শনীতে ছয়টি জলরং ছবির জন্য তিনি পেলেন সম্মানজনক পুরস্কার গভর্নরের স্বর্ণপদক। সেই সময় এই পদক ছিল শিল্পীদের জন্য বিরল সম্মানের ব্যাপার। ছাত্রাবস্থাতেই অঙ্কন শিল্পী হিসেবে জয়নুল সুনাম পেয়েছেন। কয়েকটি ঘটনাকে বিষয় করে আঁকা তার ছবি পৃথিবীর শিল্পী রসিকদের মুগ্ধ করেছিল।

    ‘দুর্ভিক্ষ’ এ শিরোনামে তিনি সিরিজ ছবি আঁকেন। ১৯৪৪ সালে ছবিগুলোর প্রদর্শনী হয়। ছবিগুলোতে তিনি আঁকলেন কাক ও কুকুরের সঙ্গে বুভুক্ষু মানুষ ডাস্টবিন থেকে খাবার খাচ্ছে। মানুষের লাশের ওপর বসে মাংস খাচ্ছে কাক ও শকুন। তিনি আঁকলেন ফুটপাতে, রাস্তায় পড়ে থাকা নিরন্ন ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি। ১৯৭০ সালে গ্রামবাংলার উৎসব নিয়ে আঁকেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ তার বিখ্যাত ছবি ‘নবান্ন’। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দেশে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়। এর ব্যাপক মানবিক ক্ষতি শিল্পীকে ব্যথিত করে। তিনি আঁকেন ৩০ ফুট দীর্ঘ ‘মনপুরা-৭০’ ছবিটি।

    জয়নুল আবেদিনের স্বপ্ন ছিল একটি সংগ্রহশালার, স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি যোগ্য শিল্পী সমাজ গড়ার। যার প্রয়োজনে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছেন চারুকলা ইন্সটিটিউট ও সোনারগাঁও লোকশিল্পের সংগ্রহশালা। তিনি নিজে এ দেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হারিয়ে যাওয়া শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তিনি ভাবতেন প্রতিনিয়ত মা, মাটি ও আমাদের সবুজ দেশের কথা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এ দেশের সুন্দর প্রতিষ্ঠায় অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি এ দেশেরই শিল্পী, এ দেশের শিল্পের উত্তরসূরি। তাঁর হাত ধরে এ দেশের সব শিল্পীর যাত্রা। শিল্পীর মর্যাদাসহ তাঁর সব শিল্পকর্মের যথাযথ সংরক্ষণসহ মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

    (ঋণ - taiyabs.wordpress.com)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @