ইতালির মিলানো শহরে বাংলার ঐতিহ্যের কাহিনি শোনায় তাঁতের বুনন

প্রাচ্যের বাংলাদেশ নামক ভূ-খণ্ডের এক ছোট সবুজ গ্রামে একদা বেড়ে উঠা ছেলেটি আজ পাশ্চাত্যের মিলানো শহরে তাঁতে পোড়েনের রঙে, নকশায়, বুননে হাজির করে স্মৃতি ছবির মগ্নতা। দেয়াল থেকে, ছাদ থেকে, কিংবা দণ্ডায়মান থেকে সে সব স্মৃতি কথা, স্বপ্ন কথা, গল্প কথারা বাংলার ঐতিহ্যের কাহিনি শোনায়। এমন এক ঐতিহ্যের, যা সভ্যতারও বুঝি অগ্রজ! তন্তু ও বয়ন মুখর ঐতিহ্যের কথা সব। প্রাচীন ও আধুনিকতার যুগলবন্দি শোনায় সে সব কথারা ।
‘গ্রামের মানুষ আমি, কেন যে এ ভাবে নষ্ট হওয়ার জন্যে
এখানে এলাম আমি, ডুবে ছিলাম ধান-কাউনের গন্ধে।
গ্রামের মানুষ আমি, আমার মুখে ছিল কাঁচা দুধের ঘ্রাণ
শরীরে পদ্ম ফুলের সৌরভ,
আমার চোখে ছিলও এক আকাশ তারা
বুকভরা স্বর্ণচাঁপার বন;
আমি কেন নষ্ট হতে এখানে এলাম।’
মিলানোর সাথে আমার সম্পর্ক নতুন বাস্তবতায়, নয়া জমানায় নয়া যাপনের। নয়া কিসিমের জানা-বুঝা-পড়া। এখন অতীতের পাল্টা আধিপত্য খুঁজতে সচেষ্ট হওয়া। জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে নেই কোনও বিশুদ্ধ চাকুরি।’ আমারও নাই। এখানে শুদ্ধতার প্রশ্নটি ঘর-গৃহস্থালির। সে অর্থে চাকুরি নয় গৃহস্থালি করি। বয়ন গৃহস্থালি।
মনে হয়, সারা জীবনটাই বুনে বুনে তৈরি। মাঝে মধ্যে উল বোনার কাটা থেকে ঘর পড়ে, যেমন খুলে যায় তেমনি জীবনের খিড়কি কপাট খুলে খুলে পড়তে চায় যেন এই অভিবাসে। কিন্তু ওই বোনার নকশা আমার কাছে হররোজ অভিনব মনে হয়। বিস্ময়ে তাই উঁকি মেরে আলগোছেতে নকশা দেখে নকশা সাজাই। কত নকশা, কত রং লটকে আছে জীবন গাছের ডালে ডালে...।
‘শব্দ সাজান কবি, যাকে কবিতা বলি,
আমি নকশাই করি, যাকে ছবি আঁকা বলি।’
আমি বয়নবাদী। সামান্য কত বয়ন, উপাসনায় আমাকে টোকা দিয়ে যায়। তাকে ক্ষুদ্রে, বিশালতায় ধরতে কি কাঙালপনা আমার। গাঁয়ে বসে লাগাতার বুনতে চাইলেও শহর কখনও সে জন্য ছুটি মওকুফ করেনি। ক্যাজুয়াল বা ঐচ্ছিক ছুটিরও বরাদ্দ পাইনি। ফলে চারপাশের যাপন যত দেখি, যাপিত হবার একঘেয়েমি আরও বেশি ধ্বস্ত করে। তবু বয়ন ভাবনা বোধ হয় আমাকে শান্ত রাখে। প্রথম পোড়েন দেবার অপেক্ষা প্রেমিকার জন্য প্রতীক্ষার চেয়েও রোমাঞ্চকর! এমন তারুণ্যের রোমাঞ্চ তৈরি করতে পারার জন্য বয়নের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বয়নকে রেডি ফুড ভাবিনি কোনো দিন, প্রার্থনা করেছি তা যেন আমাকে নিংড়ে নিয়ে গড়ে ওঠে। আমি বুনি। বুনতে আমার ভালো লাগে। বুনলে আমি ভালো থাকি। এ আমার প্রাণের দায়।
ব্যক্তিগত দেনা চুকাতে চাইলে মিলানোর কাছে আরও দেনাই বাড়বে শুধু। ইউরোপের অন্যতম চাকচিক্যের এই মহানগরে কত মনখারাপ, হাসি, বেদনা, দুঃখ-কষ্টের স্মৃতি হাড়ে-পাঁজড়ায় মিশে আছে। পিতৃত্বের দু’দুটো গেড়োর সাক্ষী হয়েছে মিলানো। পিতৃদেব-সহ চেনা কত কী হারিয়েছি এই মিলানো অভিবাসী হয়ে। গত বারো বছরে সকাল সন্ধ্যা মিলানো আমার চৈতন্য জুড়ে আধিপত্য করতে চেয়েছে। আমি লড়েছি-হেরেছি-জিতেছি। তাই ‘মিলানো তি অদিয়ো এ তি আমো’ ‘ঘৃণায়’ মিলানোকে অভিসম্পাত দিয়েও ‘ভালোবেসে’ স্বাচ্ছন্দ্যে তাকে জড়িয়ে বাস করি।
‘উড়ছে শরীরে জড়ানো বসন, হাওয়ায়
হাওয়ায় তাঁতের খটখট ধ্বনি। যুদ্ধক্ষত
মহামারী ঢেকে দেয় এমন বসন আছে,
কিন্তু সে কেবল নবী ও শিল্পীর গায়ে।’
ফসলের আদিম শরীর থেকে বুনো আমোদে গন্ধ ছড়ানো আরণ্যক গ্রাম বুকে নিয়ে নানা শহরে পিঠ ঠেকিয়েছিলাম। বুকের উষ্ণতায় এ পার্থিব অর্জন সৃষ্টির উচ্ছ্বাস হয়েছে। সেই জগতটাকেই অভিজ্ঞতা, অভীপ্সার ভাষায় রূপায়িত করতে চেয়েছি। হয়তো এমনি করে সারা জীবন ধরে নিজের শৈশবটাকে সৃজনী ভাষায় ভিন্ন পরিসরে পুনর্নির্মাণ করে যাওয়া। প্রজ্ঞায়িত অনুষঙ্গে তন্তুর ভেতর কথারা হয় দেশমাতার কথা। সে দেশ যা লোকায়ত তাৎপর্যে লিপ্ত। এই লিপ্ততায় সমঝোতা করতে হয়, রফা করতে হয় এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের অন্তর্নিহিত প্রস্তাবনার সাথে। যে দ্বন্দ্বে বস্তুর চেনা গড়নে অভিজ্ঞতার মিশেলে বদল ঘটে, কিন্তু স্বভাবচ্যুত হয় না। প্রকল্পটি জারি থাকে সংকল্পের দ্বৈতাদ্বৈতকে সঠিক মাত্রায় বাঁধবার আয়াসে। এখানে কোনো গুরু নির্দেশ বা বিধি-বিধান খাটে না। বরং বোধ ও প্রাণের ফজিলতে শিল্পায়াতে নাজিল হয়।
বৈশ্বিক তন্তুবায় শিল্প সম্প্রদায়ের এর তাঁত কাজ বিষয়ক সৃজনাশ্রয়ী কর্মধারায় কৃত আমার শিল্পকর্ম।
যা আমার নিতি-দিনলিপির ‘তন্তুবিবৃতি’। এক আত্মজ তান্তব বৃক্ষ।
যে বৃক্ষ ছায়াতলে এ বুনকরের অষ্টপ্রহর আরাধনা, কামনা, প্রার্থনায়-
একমাত্র তন্তুই হয় অর্ঘ্য-নৈবেদ্য......