রূপসী বাংলার চেয়েও জীবনানন্দ দাশের কবিতা ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, বিদ্রোহের

রবীন্দ্র পরবর্তী যেসকল কবিদের কবিতায় ‘হতাশা’, ‘নৈরাজ্য’ ও ‘সামাজিক অবক্ষয়ের’ চিত্র ফুটে উঠেছিল তাঁদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় সম্ভবত জীবনানন্দ দাশ। সৃষ্টিকর্মের কোনো বাঁককেই একটি মানদণ্ড দিয়ে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। তবু তিরিশের দশকের কবিদের কণ্ঠে শোনা গেল এক নতুন স্বর। যে স্বর চিরাচরিত ভক্তি বা প্রেম রসকে এড়িয়ে গিয়ে, বাংলা সাহিত্যে জুড়েছিল সংগ্রাম, সাম্যবাদ ও গণচেতনা।
১৯৪০-৫০-এর মধ্যবর্তী সময়টা ছিল দলিত ও বিপন্ন, জটিল ও নিষ্ঠুর দশক, এর মধ্যে থেকে একজন কবির শুধুই প্রেমানুভূতি কিংবা মুগ্ধতা নিয়ে লিখতে পারা সম্ভব না। জীবনানন্দ দাশও পারেননি। তাই কবির সৃষ্টিতেও হঠাৎ যেন নদী, মাঠ, ঘাস, শিশিরের জল-এর বদলে উঠে আসতে থাকে ভিন্ন অনুষঙ্গ, চিত্রকল্প পাল্টে যেতে থাকে বারবার। গ্রামের সহজ-সরল নিস্তরঙ্গ রূপের বদলে, তিনি কথা বলতে থাকেন সমাজের ছোটো ছোটো বিষয় আশয়- যুগ পরিবর্তনের যন্ত্রণা ও বিবর্তনের। যুগযন্ত্রণা যদিও একেকজনের কাছে একেকরকম; সেসময় কিছু মানুষের কাছে যুগ যন্ত্রনার একমাত্র স্বরূপই ছিল ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের বিকার ও বিকৃতি, বিচ্ছিন্নতা ও হতাশা।
নির্মোহ ঋষির দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত ঘৃণাকে অনুচ্চার রেখেই ব্যক্ত করতে পেরেছিলেন মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। কিন্তু জীবনানন্দ সেই সর্বাঙ্গ সূচিমূখ, বিপুল ব্যাখ্যাময়, বাস্তবতার জীবনকে ‘ঘৃণার’ মতো অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেই রেখে গেছেন, মানবসমাজের সঙ্গে তাঁর নাড়ির বন্ধনের শোণিত চিহ্ন।
কেবল এই মানসিক সংকটকেই কিছু সমাজবিজ্ঞানী যুগযন্ত্রণার উপকরণ হিসেবে তুলে ধরলেও, আধুনিক মানুষের জীবনে এসব বাদেও অর্থনৈতিক সমস্যা, শ্রেণি শোষণ, ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতাপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারনাস্ত্রের প্রসার, একশ্রেণির মানুষের দারিদ্র্যতা, গৃহহীনতা, উদ্বাস্তু জীবনের হাহাকার, মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাজের সংকট, সামাজিক সম্মান রক্ষার তাগিদ এ সকলও সেই যুগ বিবর্তনের যন্ত্রণার কারণ হিসেবে ফুটে উঠতে শুরু করলো, বিশেষত বাংলার জনজীবনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে, সাধারণ জনমানসে যেমন আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি আর্থিক অবস্থার ক্রমান্বয়ে পতন, মধ্যবিত্ত স্বপ্ন ও আশাগুলিকে গুড়িয়ে দিয়েছিলো। যে নিরাপদ ও নিঃশঙ্কা পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভৌমিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি, সেই প্রতিশ্রুতিও মিথ্যে হয়ে গেছিলো চিরতরে। রবার্ট ব্রুকের মতো পাশ্চাত্যবাদী কবিকণ্ঠে যার আভাস মিলেছে, ইউরোপীয় সাহিত্যে যা বড্ড পরিচিত বিষয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্যেও সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি যে উঠে আসতে পারে সমকালীন শিক্ষিত বাঙালিসমাজ হয়তো ভেবেই উঠতে পারেননি। নাগরিক জীবনবোধ, বিশ্বরাজনৈতিক জীবনবোধে জর্জরিত কবিমন তাই তাঁর শীতরাত কবিতায় ফুটিয়ে তুললেন নৈরাজ্যের নির্ঘণ্ট:
শহর ও গ্রামের দূরমোহনায় সিংহের হুংকার শোনা যাচ্ছে,
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।
সিংহ অরণ্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর,
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মতো খসে খসে
চুম্বক পাহাড়ের নিস্তব্ধ।”
(শীতরাত – মহাপৃথিবী)
জীবনকে পালটে নেওয়ার তাগিদে, একটু ভালো ভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে, হতাশা দৈন্যতা অভাব মুছে ফেলার তাগিদে মানুষ আশ্রয় খোঁজে শহরে। কিন্তু সেই শহর হতাশায় দীর্ণ, ক্লান্ত ও প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন মানুষকে নগরের যান্ত্রিক সভ্যতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে দেওয়ার বদলে আরও বেশি হতাশা আরও বেশি দৈন্যের মধ্যে ফেলে দেয়। শুধু তাই নয়, তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে শহর ও গ্রাম উভয় থেকেই। এ কবিতায় কবি মানুষকে সার্কাসের ব্যথিত সিংহের সঙ্গেই তাই তুলনা করেছেন, যাঁর কানে বন্য কোকিলের কুহুতান, ধরা দেয় ইঞ্জিনের যান্ত্রিকতার মতো। সে না বাঁচতে পারছে বন্য সজীবতায়, না পারছে যান্ত্রিক শহুরে শব্দমুখরতায়।
তিরিশের কবিদের কৈশোর ও যৌবনের স্বপ্নময় দিনগুলো কেটেছিল নির্মম বাস্তবতাকে সঙ্গী করে। যেখানে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো, সত্য ও সুন্দরের প্রতি উৎসাহহীনতা, ভীতি বিভ্রান্তি, পীড়িত ও যন্ত্রণাকাতরতা ছিল উজ্জ্বল। সে দশকের অর্থনৈতিক মন্দা, যে ভয়াবহ মূল্য বিপর্যয়ের জন্ম দিয়েছিলো, তা যেমন রবি ঠাকুরের মতো প্রথিতযশা কবিদের চোখ এড়ায়নি, যার প্রমাণ তাঁর ‘কালান্তর’ পর্যায়ের রচনাগুলি। ঠিক তেমনি সেকালে তথাকথিত ‘অপরিচিত’ কবি জীবনানন্দের রচনাগুলিও যেন ফুটিয়ে তুলেছে সমকালীন সামাজিক ভয়াবহতা। যার কারণ খুঁজতে গেলে উঠে আসবে বিশ শতকীয় ইতিহাসের একেকটি বিশাল ঘটনা। যে ঘটনাগুলি শতাব্দীকে আমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিলো।
বিশ্বব্যাপী একেকটি পরিবর্তন, রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তিজীবনের উত্থান-পতন, সমাজতন্ত্রের দ্রুত অবসান, গণতন্ত্রের ক্রমবিকাশ, উপনিবেশিক শক্তিগুলির ভৌমিক সাম্রাজ্য হারানো, এশীয় ও আফ্রিকান দেশগুলিতে স্বাধীনতা স্পৃহা ও সংগ্রাম, দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ, আনাবিক বোমার ধ্বংসলীলা, ফ্যাসিবাদ, স্পেনের গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, পুঁজিবাদী সভ্যতার বিভীষিকা যেমন জীবনানন্দ-সহ এ সময়ের কবিদের প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে, ঠিক তেমনি তাঁরা সাক্ষী থেকেছেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের। মানবিকতার বিজয়ের, বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্য সহ, বুদ্ধি ও চিন্তার প্রকাশের স্বাধীনতারও। তিরিশের কবিদের বাকিদের মতো জীবনানন্দও অধীত বিদ্যায় পারদর্শী, দর্শনে পারঙ্গম, ইউরোপীয় সাহিত্যে ব্যুৎপন্ন ও সমাজ, রাষ্ট্র, ইতিহাস ও মনস্তত্বের প্রতি সমান কৌতুহলী ছিলেন, এই তিরিশের কবিদের প্রধান লক্ষ্য ছিল –
১. প্রথমত, রবীন্দ্রপ্রভাবকে কাটিয়ে ওঠা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কাব্যধারা থেকে বেরিয়ে, নতুন এক শৈলীর সৃষ্টি করা, যা মূলত কবি জীবনানন্দ স্বার্থকভাবে করতে পেরেছিলেন, কাব্যকলায় বিচিত্র ইজম প্রয়োগ ও শব্দ নিরীক্ষার মাধ্যমে। এছাড়াও চিরাচরিত কবিতার উপমাগত বা ভাষাগত মারপ্যাঁচকে এড়িয়ে, কবিতাকে মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দন দান সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম সফল ভাবে করতে পেরেছিলেন।
২. দ্বিতীয়ত, যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর বিশৃঙ্খল, অস্থির, হতাশাদীর্ন ও রুগ্ন জীবনচিত্র কাব্যে ফুটিয়ে তোলা।
মানুষের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবক্ষয়ের ষড়যন্ত্র-সভ্যতা বিনাশের যে চক্রান্ত মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, কবি সেকথা নির্নিমেষে বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বভাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে, রক্তপাত তথা বিনাশ; তাই কবি কলমে ফুটে উঠেছে-
চারিদিকে নবীন যদুর বংশ ধ্বংসে
কেবলই পড়িতে আছে;
সঙ্গীতের নতুনত্ব সংক্রামক ধূয়া নষ্ট করে দিয়ে যায়,
স্মৃতির ভিতর থেকে জন্ম লয়, এইসব গভীর অসুয়া।
(আমিষাশী তরবারি - অগ্রন্থিত কবিতা)
মানুষের মনে প্রেম থাকে, থাকে বিস্ময়, তেমনি থাকে সম্ভাবনা। সব প্রেম, সব বিস্ময়, সব সম্ভাবনা মানুষের হয়তো পূরণ হয় না। আর যখন হয় না তখনই মানুষ ডুবে যায় হতাশার সমুদ্রে, তাঁর মনে প্রেমের বদলে অ্যাবসার্ড এসে দখল নেয়। মানুষের সুন্দর চিন্তা, চেতনা, বোধ, বিস্ময় কীভাবে দুর্দিনের দুর্বিপাকে বদলে যায় চরম হতাশায় কবি তাঁর সেই বাস্তব নিরীক্ষণও তুলে ধরেছেন তাঁর ‘এই নিদ্রা’ কবিতায়। দেখিয়েছেন স্থূল জগৎ থেকে পরাবস্তুবের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা।
শুনেছে সে ইহাদের মুখে কোনো অন্ধকার কথা?
সকল সংকল্প চিন্তা রক্ত আনে ব্যাথা আনে,
মানুষের জীবনের এই বীভৎসতা
ইহাদের ছোঁয় নাকো;
ব্যবনিক প্লেগের মতন
সকল আচ্ছন্ন শান্ত স্নিগ্ধভাবে নষ্ট করে ফেলিতেছে
মানুষের মন।
(এই নিদ্রা - অগ্রন্থিত কবিতা)
সভ্যতার বর্বর মুখ দেখে, রূপসী বাংলার মগ্ন প্রকৃতিচারী আমাদের চেনা কবি স্থির থাকতে পারেননি। কলম ধরেছেন, দলিত, বিপন্ন, নিষ্ঠুর সময়ের সব পুরাণ লিখতে।
উত্তেজিত কঠিন দেবতারা
অপরুপ মদ খেয়ে মুখ মুছে নিয়ে
পুনরায় তুলে নেয় অপূর্ব গেলাস
উত্তেজিত না হয়েই অনায়াসে বলে যায় তারা,
হেমন্তের ক্ষেতে কবে হলুদ ফসল ফলেছিল?
শুধু কি তাই, বিশ শতকের মরণোত্তর সভ্যতা মানুষকে একথা খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, যে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের হিসেবি কূটনৈতিকতার অংশমাত্র। তাই আত্মঘাতী ক্লান্তিতে আক্রান্ত কবি জানাচ্ছেন –
যেসব যুবারা সিংহীগর্ভে জন্মে পেয়েছিলো
কৈটিল্যের এর সংযম
তারাও মরেছে আপামর।
(একটি কবিতা - সাতটি তারার তিমির)
কালের নিসর্গ অসঙ্গতিকে প্রাণপনে শোষণ করে নিয়ে, নির্মোহ ঋষির দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত ঘৃণাকে অনুচ্চার রেখেই ব্যক্ত করতে পেরেছিলেন মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ সেই সর্বাঙ্গ সূচিমূখ, বিপুল ব্যাখ্যাময়, বাস্তবতার জীবনকে ‘ঘৃণার’ মতো অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেই রেখে গেছেন, মানবসমাজের সঙ্গে তাঁর নাড়ির বন্ধনের শোণিত চিহ্ন। জীবনানন্দ রূপসী বাংলার কবি। তবু তাঁর কলমে ঘৃণার যে তীব্রতা প্রকাশ পেতে দেখি, তা কারো লেখায় এত প্রাঞ্জলতায় ধরা দেয়নি।
সূর্যের রোদে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি
শুয়োরের আর্তনাদে
উৎসব শুরু করেছে।
(অন্ধকার- বনলতা সেন)
জীবনানন্দের অস্থিরতা, ক্লান্তি, বিষাদ, বিপন্নতা, সঙ্গহীনতা, অন্যমনস্কতা সবেরই মূলেই ছিল হয়তো জীবনের কোন গভীরতম সত্যের জন্য তাঁর ব্যাকুলতা। গাঢ় ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যে সমাজ সচেতনার বা মগ্নচৈতন্যের গভীরে তাঁর সে বিরামহীন যাত্রা সেইটাও ছিল এক নতুন জীবনদর্শন উন্মোচনেরই প্রয়াস।
ব্যোদলেয়ারের মতো জনপ্রিয় ফরাসি কবির ভাবনেত্রে যেমন চারদিকই অন্ধকার আচ্ছন্ন, কোথাও আশার, আকাঙ্ক্ষার ও জীবনবোধের আলো নেই, বাঙালি কবি জীবনানন্দও তেমনি অন্ধকারের মধ্যে থেকে মানুষের স্বভাবে পান ‘চিল’, ‘শকুন’, ‘শুয়োরের’ মতো জানোয়ারের স্বভাব। ‘অন্ধকার’ কবিতায় কবি অন্যের মুখ ম্লান করে দেওয়ায় সুখী, আধুনিক তথাকথিত ‘সভ্য’ মানুষগুলিকে তাই শুয়োরের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন, “কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদ”। আবার ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় ক্ষমতাবান জনজাতির সামাজিক আগ্রাসনের যে মর্মস্পর্শী ছবি তুলে ধরেছেন কবি জীবনানন্দ, সেখানে কবির নিজস্ব ব্যর্থতা হতাশাও ফুটে উঠেছে, যা সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের জগতে তৈরি করেছিল অন্য এক ঘরানা।
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই, প্রীতি নেই
করুণার আলোড়ন নেই,
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
(অদ্ভুত আঁধার এক - জীবনানন্দের অন্যান্য কবিতা)
সংশয়, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, নির্বেদ, নিঃসঙ্গ চেতনা ও বিস্বাদের পাশাপাশি তাঁর কবিতায় পাঠকমহল হয়তো প্রথম শুনেছিল তিমির হননের উচ্চারণ, যা তাঁকে তিরিশের বাকি কবিদের থেকে, এমনকী রবীন্দ্রনাথের থেকেও স্বতন্ত্র করে দিয়েছে আজীবনের জন্য। আবার অন্ধকারের জীবনেই কবির স্থির বিশ্বাস, নতুন ভোর আসবেই, তাই তো মৃত্যুশব্দ, রক্তশব্দ ও ভীতিশব্দ জয় করতে কবি লিখছেন,
চলেছে নক্ষত্র, রাত্রি, সিন্ধু, রীতি, মানুষের বিষণ্ণ হৃদয়
জয়, অস্ত সূর্য, জয়, অলখ অরুণোদয়, জয়।
(সময়ের কাছে - সাতটি তারার তিমির)
জীবনানন্দের অস্থিরতা, ক্লান্তি, বিষাদ, বিপন্নতা, সঙ্গহীনতা, অন্যমনস্কতা সবেরই মূলেই ছিল হয়তো জীবনের কোন গভীরতম সত্যের জন্য তাঁর ব্যাকুলতা। গাঢ় ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যে সমাজ সচেতনার বা মগ্নচৈতন্যের গভীরে তাঁর সে বিরামহীন যাত্রা সেইটাও ছিল এক নতুন জীবনদর্শন উন্মোচনেরই প্রয়াস। আজও পাঠকমহলে রয়ে গেলেন অচেনা, অজানা একজন, যাঁর কবিতাজুড়ে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, বিদ্রোহের স্রোতধারা এমন দীপ্ত ভাবে ফুটে ওঠে, তাঁকে কি শুধুই রূপসী বাংলায় মগ্ন প্রকৃতিচারী কবি বলা যায়?