No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ফেরিওয়ালা থেকে সেলিব্রিটি যাত্রাশিল্পী: গোপাল উড়ের অভিনয়ে মুগ্ধ রাজা নবকৃষ্ণ  

    ফেরিওয়ালা থেকে সেলিব্রিটি যাত্রাশিল্পী: গোপাল উড়ের অভিনয়ে মুগ্ধ রাজা নবকৃষ্ণ  

    Story image

    হরিদাসী বৈষ্ণবী গান শোনাতে এসেছে – ‘মা-ঠাকুরানিরা গান শুনবে?’ আবালবৃদ্ধার জোরালো কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘শুনব, শুনব’। তা কী গান শুনতে চায় তারা? ‘কেহ চাহিলেন গোবিন্দ অধিকারী – কেহ গোপাল উড়ে...’।

    বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ উপন্যাস। গোবিন্দ অধিকারীর পাশে উড়িষ্যার জাজপুর থেকে আসা গোপাল উড়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছেন। 

    অবশ্য হবে নাই বা কেন? কীর্তি তো তাঁর নেহাৎ কম নয়। ছিলেন সামান্য কলাবিক্রেতা, সেখান থেকে লাফ দিয়ে যাত্রাপালার জনপ্রিয় অভিনেতা। শহরের তাবড় বাবুরা পর্যন্ত গোপাল উড়ে বলতে জ্ঞান হারাত। সে কি আর যে-সে মানুষ! 

    তবে কলকাতার ফেরিওয়ালাদের গুণের এমনিই শেষ নেই। সেকাল হোক আর একাল- সেসব গুণ বহরে বেড়েছে আরো। সেই কবেকার গল্প রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন, চৈত্র-বৈশাখ মাসে ‘বরীফ’ বলে হেঁকে যেত বিক্রেতা,  ‘চুড়ি চাই...’ ডাকে বাড়ির বালিকাবধূটির দুপুরের ঘুম যেত ছুটে। এছাড়া নানানসুরে বিক্রি হত বেল ফুল, তোপসে মাছ, বাসন। হৃদয়ে কাঁপন-ধরানো সেসব সুরে গেরস্ত বাড়ির লোক সাড়া দিতে বাধ্য হত বৈকি!  নিশ্চয়ই তানপুরা কাঁধে দু-বেলা রেওয়াজের সময় তাদের মিলত না। প্রতিভা না-থাকলে ফেরি করা যার-তার কম্ম না। গলাকে দুমড়ে-মুচড়ে, তারসপ্তক থেকে এক লাফে মন্দ্রে নেমে ক্রেতার মন জয়, তাও প্রত্যহ- আশ্চর্য ঘটনাই বটে!

    তা গোপাল উড়ে দারিদ্রের দায়েই একদিন এসে পড়েছিলেন কলকাত্তা শহরে। তাঁর বাবার নাম ছিল মুকুন্দ। বেগুন আদা- এইসব চাষবাস করতেন। কিন্তু দিন চলত না। গোপাল তাঁরই পরামর্শে এলেন কলকাতায়। বাংলাভাষা তখনো তাঁর রপ্ত নয় ঠিকই। তবু গলাখানি ছিল দরাজ। কলা বিক্রি করতেন রাজপথে। কত আয় হত জানা যায় না, তবে একদিন হঠাৎই তাঁর বরাত খোলে। ফেরি করার সময় তাঁর অসাধারণ কণ্ঠস্বর মুগ্ধ করেছিল রাধামোহন সরকারকে। তাঁরই  ‘বিদ্যাসুন্দর’ দলে চাকরি পান তিনি। বেতন হয়, দশ টাকা। যাত্রাপালায় থাকতে হলে ভালো গান জানা চাই। হরিকিষণ মিশ্রের কাছে গানের তালিম নেওয়া চলে গোপালের। গান গাওয়ার সহজাত ক্ষমতা গোপালের। সা রে গ ম- তাঁকে সাধতে হয়নি। বরং আয়ত্ত করেছিলেন ঠুংরি। এক বছরের মধ্যে বাংলাভাষাটাও বেশ সরগর হয়ে এসেছিল তাঁর।

    প্রথম অভিনয় ছিল রাজা নবকৃষ্ণের বাড়িতে। গোপাল উড়ে মালিনীর ভূমিকায় গান ধরলেন। শোনা যায় তাঁর গান শুনে ‘দর্শকমাত্র চিত্রপুত্তলিকা’য় পরিণত হয়েছিলেন। মুগ্ধ রাজা নবকৃষ্ণ। প্রথম অভিনয়েই বাজিমাত গোপালের। এরপর রাধামোহনের যাত্রার আসরের ডাক পড়তে লাগল, যত্রতত্র। হাটখোলার দত্তবাড়ি, সিমুলিয়ার ছাতুবাবুর বাড়ি। গোপাল উড়ের বেতন দশ টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা। তাঁর গানের খ্যাতি তখন সর্বত্র। পাশাপাশি তাঁর ব্যবহারটিও নাকি ছিল ভারি মিঠে। খুব সুন্দর কথা বলতেন নাকি৷  রোগা, ফরসা চেহারা ছিল। দেখামাত্রই লোকের ভালোলাগত তাঁকে।  রাধামোহনের মৃত্যুর পর যাত্রাদলটি উঠে যায়। কিন্তু দলের প্রচুর আসবাব সামগ্রী ও অন্যান্য জিনিসপত্র গোপাল উড়ের হস্তগত হয়। গোপাল উড়ে এরপর নিজেই খুলে বসেন একটি দল। সেই দলের অপূর্ব সব গান মুগ্ধ করত শহরের মানুষকে। গোপাল উড়ে নিজেই রচনা করতেন সেসব গান। এই শহরের গায়ে তখন যৌবনের গন্ধ। তার পুরোনো গ্রামীণ শিকড়টি ভালোভাবেই রয়েছে, আর রয়েছে নিত্যদিনে নতুনের ছোঁয়াচ। কলকাতায় কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের মতো উৎসব আনন্দে মেতে উঠতে পারত। যাত্রাপালা হোক, বা সং-এর আসর হোক।  বিদ্যেবোঝাই বাবুইমশাইরা অনেকেই  নাকচ করতেন হয়তো। কিন্তু তারপরেও পালকিবাহক থেকে শুরু করে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষদের উৎসব অনুষ্ঠানে ভাটা পড়ত না। গোপাল উড়ের আড়খেমটা তালের গান শ্রমজীবী মহল্লায় যেমন ঢেউ তুলেছিল, তেমনি উঁচুতলাতেও পৌঁছেছিল। অবশ্য এখানে একটি বিতর্ক আছে। কেউ কেউ বলেন, গোপাল উড়ে সেসব গান রচনা করেননি। করেছিলেন, তাঁর দলেরই রাম অধিকারী ও পরমানন্দ অধিকারী। সেসব গান নাকি গোপাল উড়ের নামেই প্রচলিত ছিল। 

    সেসব গানের চলনবলন আজও মুগ্ধ করে। তাছাড়া  ‘ওই দেখা যায় বাড়ি আমার...’ গানটির সঙ্গে আশ্চর্য মিল পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়...’ গানটির। চলন প্রায় এক। 

    গোপাল উড়ে বেশিদিন বাঁচেননি। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। কিন্তু পুরোনো কলকাতার গানের জগতে অবশ্যই অবিস্মরণীয়  থেকে যাবেন তিনি। শুধু গানও সেগুলি নয়, পুরোনো কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

    ঋণ: ‘উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান’- সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
    ‘বাঙ্গালীর গান’- দুর্গাদাস লাহিড়ী 

    ছবি: রাজা নবকৃষ্ণ (সূত্র – শোভাবাজার রাজবাড়ি) 

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @