No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলার প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র ও তার সাংবাদিক 

    বাংলার প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র ও তার সাংবাদিক 

    Story image

    অনেকটা যেন, ছিল বেড়াল আর হয়ে গেল রুমালের মতো।  জেমস অগাস্টাস হিকির জীবনটা এমনই হ য ব র ল। ছিলেন ডাক্তারের সহকারী,  কম্পাউন্ডার-গোছের কিছু, সেখান থেকে হয়ে গেলেন ডাক্তার, ডাক্তার থেকে প্রিন্টার, প্রিন্টার থেকে স্বাধীনচেতা লড়াকু সাংবাদিক, সেখান থেকে আবার ডাক্তার – আমাদের আশ্চর্য হওয়ার সীমা থাকে না।  তারই মাঝে কারাবাস, ঋণ ও আরো কতকিছু। এতসব বৈচিত্র্যোর মধ্যে আমাদের পাওনা যেটা, তা হল হিকির গেজেটটি।

    হিকি জন্মসূত্রে ছিলেন আইরিশ। লন্ডনের শিক্ষানবিশি ছেড়ে ঠিক কীসের আহ্বানে এই দেশের প্রতি হিকি পা বাড়িয়েছিলেন, তা বোঝা মুশকিল। তবে এত বৈচিত্র্যশ যার চরিত্রে, সে নিশ্চয়ই কোনো রোমাঞ্চকর কিছুর সন্ধান পেয়েছিল। ১৭৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে হিকি বাংলায় আসেন। আসার সময় তিনি ছিলেন এক ডাক্তারের সহকারী।  জাহাজে দীর্ঘপথ  অতিক্রমের সময় নিশ্চয়ই কিছুটা চিকিৎসা-পদ্ধতি রপ্ত করেছিলেন। তা বাংলার মাটি স্পর্শ করতেই হয়ে পড়লেন ডাক্তারবাবু। তবে ব্রিটিশ রোগী দেখার খুব একটা সুযোগ তাঁর হত না। দেখতে হত, এদেশি রোগী। তাদের দেখে কি আর পসার জমানো যায়? রোজগারে টান পড়ে। 

    কী করা যায় ভাবতে ভাবতে প্রিন্টার হয়ে উঠলেন একদিন। হ্যান্ডবিল থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন ছাপার কাজ শুরু হল। সৌভাগ্যক্রমে সরকারি কাজও জুটে গেল মোটা টাকার। সেনাবাহিনীর নিয়মকানুন ছাপতে হয়েছিল তাঁকে। প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার রফা হয়েছিল।  তা সেসবের ঝক্কি সামলে উঠেই হিকিসাহেব একদিন প্রকাশ করলেন বাংলার প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র৷ নাম ‘বেঙ্গল গেজেট’। মুখে মুখে নাম ছড়াল, হিকির গেজেট।  ১৭৮০ সালের ২৯শে জানুয়ারি প্রথম প্রকাশ।  আট ইঞ্চি চওড়া, লম্বায় বারো ইঞ্চি চমৎকার ছাপা-কাগজ। খবরের থেকে ছাপা কাগজের বিস্ময়টাই মানুষের তখন বেশি। এর আগে নাকি বোল্ট নামের কোনো এক ব্যক্তি হাতে লেখা খবরের কাগজ বের করতেন। তাঁর বাড়িতে গিয়ে কাগজ পড়ে আসতে হত সাহেবদের। স্বাভাবিকভাবেই হিকির কাগজ জন্মলগ্নেই বাজিমাত করে দিয়েছিল। 

    কিন্তু শুধু কাগজ বের করলেই তো হয় না। টিআরপি  সেসময়ও ছিল, একটু অন্যভাবে। আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে, সদ্য গজিয়ে ওঠা কলকাতা ‘শহর’এ কী আর এমন খবর থাকতে পারে। আজকের মতো লিংকভর্তি খবর কোথায়ই বা তখন, যা খোদ সাহেবদের চকমা দিতে পারে। 

    হিকি কিন্তু সুবিধামতো একটা পন্থা নিয়েছিলেন। সিরিয়াস খবরাখবরের পাশাপাশি দিব্বি পরনিন্দা পরচর্চাকে খবরের কাগজের গুরুত্বপূর্ণ কলাম করে তুললেন। কোনো পদস্থ ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা গোপন খবরাখবর, প্রশ্রয় কিংবা প্রণয়, কোনো নামজাদা মহিলার  পোশাক নিয়ে ব্যঙ্গ – দিব্বি বেঙ্গল গেজেটের পাতা আলো করে থাকত। যতক্ষণ না নিজের ঘরে ডাকাত পড়ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সাহেবরা ভালোই আনন্দ পেতেন এই গেজেটে। ছাড় পেতে পেতে হিকিও শেষপর্যন্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলেন আরকি। হেস্টিংস ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এলিজা ইম্পেকে নিয়েও কূটকচালিতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন পত্রিকার পাতা। ছোটো ছোটো নাটক লিখে,  মনমতো চরিত্র তৈরি করে, মনমতো খবর সাজিয়ে যেন আড়ালে হোহো হাসি হাসতেন হিকি সাহেব। 

    আর যায় কোথা, একদিন চারশো পুলিশ হাজির হিকির এন্টালির বাড়িতে৷ তাদের সঙ্গে একা লড়াই করে নাকি কোর্টে গিয়েছিলেন সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকতে৷ কাল হয়ে দাঁড়াল, এই ঘটনা। একটার পর একটা মামলা জড়ো করে হিকির হাজতবাস হল। সেখান থেকেও সমানে কাগজ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ক্রমাগত সওয়াল করেছিলেন। একে ঋণে জর্জরিত, তারপর মানহানির অত্তগুলি মামলা- তবু হিকিসাহেব ভাঙেন কিন্তু মচকান না। 

    হেস্টিংসের দয়ায় কারাজীবন থেকে রেহাই মিললেও, কাগজ আর চালাতে পারেননি হিকি। দেনার দায়ে প্রায় ডুবতে বসেছিলেন। এমনকি কোম্পানির থেকে প্রাপ্য টাকাটাও আদায় করতে হন্যে হতে হয়েছিল হিকিকে। প্রায় ষোলো বছর ধরে অনেক কোর্টকাছারি, অনেক লেখালেখি, অনেক তদবির করে দেশে ফেরার টাকাটুকু উদ্ধার করেছিলেন। তবে দেশে আর ফেরা হয়নি। সমুদ্রপথেই জীবনাবসান।  

    সাহেবদের যতই চক্ষুশূল হোন না কেন, এদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে হিকি চিরকালই অম্লান। হতে পারে, তেমন উন্নত সাংবাদিকতা ছিল না তাঁর। তখন অবশ্য ‘সংবাদ’এর চরিত্রও আলাদা ছিল। তবু, স্বাধীনতার পক্ষে শেষাবধি লড়াই করে যাওয়া হিকি কিন্তু এক নতুন ট্র্যাডিশনই তৈরি করে দিয়েছিলেন।     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @