No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলা সাহিত্যের সর্ববৃহৎ রামায়ণে সাতের বদলে রয়েছে আটটি কাণ্ড

    বাংলা সাহিত্যের সর্ববৃহৎ রামায়ণে সাতের বদলে রয়েছে আটটি কাণ্ড

    Story image

    রাম-রাবণের যুদ্ধ | ছবি - সংগৃহীত

    মধ্যযুগে বাংলার সাহিত্যে ছিল খুবই সমৃদ্ধ। সাহিত্যের অনেক রকমের ধারা, বিষয়ের নানা বৈচিত্র্য আমাদের সংস্কৃতিকে তখন বিশাল নদী অববাহিকার মতো শস্যশ্যামলা করে রেখেছিল। পরে সেই উর্বর ভূমিতে সহজেই আধুনিক সাহিত্য বিকশিত হওয়ার পরিবেশ পেয়ে যায়। মধ্যযুগে বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য, শাক্ত পদাবলী, গীতিকা সাহিত্য, নাথ সাহিত্য, বাউল সাহিত্য ইত্যাদির পাশাপাশি অনুবাদেও কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন বাংলার কবিরা। সংস্কৃত, হিন্দি, আরবি, ফার্সি – নানা ভাষা থেকে সেরা সেরা সাহিত্য ওই সময়ে আমাদের ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। শাসকদের উদ্যোগ এবং উৎসাহেও ঘটেছে প্রচুর অনুবাদের কাজ। তবে বাংলায় তখন আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদের ওপরেই জোর দেওয়া হয়েছিল। তাই অনুবাদ সাহিত্য অর্জন করেছে স্বতন্ত্র সৃষ্টির মর্যাদা। 

    গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বরবক শাহের আদেশে বাংলা ভাষায় রামায়ণ প্রথম অনুবাদ করেন কৃত্তিবাস ওঝা। ‘বাল্মীকি রামায়ণ’ অনুসরণে তাঁর লেখা কাব্যটির নাম ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ এবং বাঙালিদের কাছে সেটি ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ নামে পরিচিত। এই কাব্যের দৌলতে রাম, লক্ষ্মণ, সীতার মতো পৌরাণিক চরিত্রেরা বাংলার ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছেন। সাবলীলতার গুণে সমস্ত বঙ্গদেশ জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’। সেই তুলনায় মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় লেখা সর্ববৃহৎ রামায়ণ তত বেশি প্রচার পায়নি। সেই রামায়ণ লিখেছিলেন সাধক কবি জগৎরাম বা জগদ্রাম এবং তাঁর ছেলে রামপ্রসাদ। কিংবদন্তি অনুযায়ী, জগৎরাম নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর কাব্য যেন জনসমক্ষে প্রকাশিত না হয়। প্রকৃত ধর্মপ্রাণ এবং সৎ ব্রাহ্মণ ছাড়া কেউ তাঁর পুঁথি অনুলিখন করতে পারবে না। তাঁর বংশধরেরা এই রামায়ণ কিংবা জগৎরাম ও রামপ্রসাদের লেখা অন্যান্য কাব্য প্রকৃত ধর্মপ্রাণ লোকের বাড়ি গিয়ে গাইতে পারবেন, কিন্তু এর জন্য পারিশ্রমিক নিতে পারবেন না। 

    ১৮ শতকে পঞ্চকোট রাজ্যের শিখরভূম এলাকার ভুলুই গ্রামে বাস করতেন সাধক কবি জগদ্রাম বা জগৎরাম রায়। ভুলুই গ্রাম এখন বাঁকুড়া জেলার মেজিয়া থানার অন্তর্গত। জগৎরামের পূর্বপুরুষরা কাশীপুরের রাজার থেকে ভুলুই গ্রামে বসবাসের জমি এবং উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁদের পারিবারিক পদবি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। জগৎরাম কার উপাসনা করতেন, তা নিয়ে গবেষকরা একমত নন। কেউ বলেন, তিনি ছিলেন পঞ্চোপাসক, কারো মতে তিনি বৈষ্ণব ছিলেন। জগৎরাম ছিলের রামচন্দ্রের পূজক – এই মতও পাওয়া গেছে। রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করা সেই ভক্তিরই প্রমাণ। আবার কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন, তিনি দুর্গার সাধনা করতেন। ভুলুই গ্রামে অষ্টনায়িকা দুর্গার মন্দির স্থাপন করেছিলেন তিনি। 

    বড়ো দাদা জিৎরামের আদেশে রামায়ণ অনুবাদ শুরু করেছিলেন জগৎরাম। বড়ো ছেলে রামপ্রসাদ তাকেঁ এই মহৎ কাজে সাহায্য করেন। দু’জনের যৌথ প্রচেষ্টায় কাব্যটি সম্পূর্ণ হয়। ‘জগদ্রামী রামায়ণ’ বা ‘শ্রী অদ্ভুত রামায়ণ’ নামে পরিচিত এই কাব্যে অন্য সব রামায়ণের মতো সাতটি নয়, আটটি কাণ্ড আছে। ‘লঙ্কাকাণ্ড’ এবং ‘উত্তরাকাণ্ড’-র মাঝখানে এই কাব্যে দেখা যায় ‘পুষ্করকাণ্ড’। সেই কাণ্ডে রয়েছে দশানন রাবণের থেকে অনেক বেশি বলশালী সহস্রস্কন্ধ রাবণের গল্প। সহস্রস্কন্ধ রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে রামচন্দ্র অজ্ঞান হয়ে যান। সীতা তখন দুর্গা, কালী ও চণ্ডীর সমন্বয়ে রণচণ্ডী রূপ ধারণ করে সহস্রস্কন্ধকে বধ করেন। এই কাণ্ডটি থাকার জন্য ‘জগদ্রামী রামায়ণ’-এর আরেক নাম ‘অষ্টকাণ্ড রামায়ণ’। 

    এছাড়াও, রাধাকৃষ্ণের রাসলীলার অনুসরণে জগৎরাম তাঁর কাব্যে ‘রামরাস’ নামের একটি অংশ যোগ করেছিলেন। তাই, অনেকের মতে, এই রামায়ণে কাণ্ডের সংখ্যা নয়টি। ‘জগদ্রামী রামায়ণ’-এ আরও বেশ কিছু গল্প আছে, যা ‘বাল্মীকি রামায়ণ’ ও ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’-এ পাওয়া যায় না। ‘বাল্মীকি রামায়ণ’, ‘অধ্যাত্ম রামায়ণ’, ‘অদ্ভুত রামায়ণ’, ‘হনুমৎ সংহিতা’-র মতো একাধিক গ্রন্থ অবলম্বন করে বাংলা সাহিত্যের সর্ববৃহৎ এই রামায়ণ রচিত হয়েছে। বাবার নির্দেশে রামপ্রসাদ ‘লঙ্কাকাণ্ড’ এবং ‘উত্তরাকাণ্ড’-র বেশিরভাগ অংশ লেখেন। 

    এই রামায়ণ ছাড়াও জগৎরাম ও রামপ্রসাদ যৌথভাবে লিখেছেন ‘দুর্গাপঞ্চরাত্রি’ নামের বই। দার্শনিক তত্ত্বে ভরপুর গ্রন্থ ‘আত্মবোধ’ রচনা করেছেন সাধক জগৎরাম। রামপ্রাসাদ একার প্রচেষ্টায় লিখেছেন ‘কৃষ্ণলীলামৃতসিন্ধু’ নামের কাব্যগ্রন্থ। 

    তথ্যসূত্র – পঙ্কজ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তিলক পুরকায়স্থ, সুস্মিতা অধিকারী। 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @