No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    যদুভট্ট ও তাঁর গান

    যদুভট্ট ও তাঁর গান

    Story image

    সময়টি ১২৮২(ইং ১৮৭৫), আষাঢ়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হল একটি বিজ্ঞাপন- ‘ব্রহ্মসংগীতের উন্নতির জন্য শুরু হচ্ছে সংগীত শিক্ষার স্কুল। ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরের দ্বিতলায় প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে এই স্কুল। সংগীত শেখাবেন বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী যদুনাথ ভট্টাচার্য।’ বাংলার শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাসে যদুনাথ ভট্টাচার্য এক যুগান্তকারী পুরুষ। তাঁর কাছেই সংগীত শিক্ষাগ্রহণ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিরা। কথিত আছে, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথকে সংগীত শিক্ষা দিতেন ১৭৭ বছরের পুরনো তানপুরা নিয়ে।

    বাংলার একমাত্র শাস্ত্রীয় সংগীতের ঘরানা হল বিষ্ণুপুর ঘরানো। এই ঘরানা একজন বিশিষ্ট শিল্পী হলেন যদুনাথ ভট্টাচার্য। তবে যদুভট্ট নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি পঞ্চকোটের রাজসভার সভাগায়ক ছিলেন। একবার এক পঞ্চকোটের রাস উৎসবে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পান। তাঁর অসাধারণ গান শুনে আপ্লুত হন রাজা। এবং রাজগায়ক হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার কথা বলেন। কিছুদিন পর হঠাৎ ঝোলা ও তানপুরা নিয়ে হাজির হন রাজদরবারে। তাঁর গায়কির জন্য পঞ্চকোটের মহারাজা নীলমণি সিংহ তাঁকে ‘রঙ্গনাথ’ এবং ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মানিক্য ‘তানরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু তিনি পঁচেটগড়ে ছিলেন মাত্র দেড়বছর।

    ১৮৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন যদুভট্ট। জীবনের অনেকটা সময় তাঁর কেটেছিল বিষ্ণুপুরের কাছে খাদাকুড়ি নামক গ্রামে। তাঁর বাবা মধুসূদন ভট্টাচার্য ছিলেন বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ও যন্ত্রশিল্পী। তিনি তাঁর বাবার কাছেই শিখেছিলেন সেতার ও মৃদঙ্গ বাজানো। তিনি সংগীত শিক্ষা শুরু করেন পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য ও গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায় সেই সময় ছিলেন বিষ্ণুপুর রাজসভার রাজগায়ক। তিনি বাংলা ও হিন্দিতে অনেক গান লিখেছিলেন।

    বঙ্কিমচন্দ্র নিজে যদুভট্টের কাছে সংগীত শিক্ষাগ্রহণ করলেও বন্দেমাতরম গানটির প্রথম সুর নাকি তৈরি করেছিলেন যদুভট্ট। ভাটপাড়ায় বসে তিনি এই সুর তৈরি করেন। সেইসময় এই গানটি তৈরি করা হয়েছিল রাগ- মালহার, তাল কাওয়ালি-তে।

    ‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা। জোড়াসাঁকো বাড়িতে সকাল সন্ধ্যা চলছে দেশীয় গানের চর্চা। বালক রবিকেও পাঠানো হল গান শেখার জন্য বিষ্ণু চক্রবর্তীর কাছে। রবীন্দ্রনাথের যখন তেরো-চোদ্দ বছর বয়স, বিষ্ণুপুর ঘরানার যদু ভট্ট আসেন কলকাতায়। তাঁর কাছে শুরু হয় শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চা। অপরদিকে পাথুরেঘাটার প্রিন্স সুরেন্দ্রমোহন টেগোর বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর কাছে নাড়া বেঁধেছেন তখন। ফলে বিষ্ণুপুর ঘরানার সব তাবড় তাবড় গাইয়েদের সমাবেশ ঘটত জোড়াসাঁকো ও পাথুরেঘাটা রাজবাড়িতে। বিষ্ণুপুর ঘরানা ও তার রাগগুলির প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই আত্মিকতা ও ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অনেক গানে।

    পাশাপাশি, একটি বক্তৃতায় এও বলেছেন রবীন্দ্রনাথ – ‘...বাল্যকালে আমাদের ঘরে ওস্তাদের অভাব ছিল না; সুদূর থেকে অযোধ্যা গোয়ালিয়র ও মোরাদাবাদ থেকে, ওস্তাদ আসত। তা ছাড়া বড়ো বড়ো ওস্তাদ ঘরেও বাঁধা ছিল। কিন্তু আমার একটা গুণ আছে-- তখনো কিছু শিখি নি, মাস্টারির ভঙ্গি দেখালেই দৌড় দিয়েছি। যদুভট্ট আমাদের গানের মাস্টার আমায় ধরবার চেষ্টা করতেন। আমি তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে দৌড় দিতাম। তিনি আমাদের কানাড়া গান শিখাতে চাইতেন। বাংলাদেশে এরকম ওস্তাদ জন্মায় নি। তাঁর প্রত্যেক গানে একটা originality ছিল, যাকে আমি বলি স্বকীয়তা। আমি অত্যন্ত "পলাতকা' ছিলুম বলে কিছু শিখি নি, নইলে কি তোমাদের কাছে আজকে খাতির কম হত? এ ভুল যদি না করতুম, পালিয়ে না বেড়াতুম, তা হলে আজকে তোমাদের মহলে কি নাম হত না? সেটা হয়ে উঠল না, তাই আমি এক কৌশল করেছি - কবিতার-কাছঘেঁষা সুর লাগিয়ে দিয়েছি। লোকের মনে ধাঁধা লাগে; কেউ বলে সুর ভালো, কেউ বলে কথা ভালো। সুরের সঙ্গে কথা, কবি কিনা। কবির তৈরি গান, এতে ওস্তাদি নেই। ভারতীয় সংগীত ব'লে যে-একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার আছে, আমার জন্মের পর তার নাকি ক্ষতি হয়েছে-- অপমান নাকি হয়েছে। তার কারণ আমার অক্ষমতা। বাল্যকালে আমি গান শিখি নি-- এতে সহজে শেখা যায় না, শিখতে কষ্ট হয়, সেই কষ্ট আমি নেই নি। সেজদাদা শিখতেন বটে-- তিনি সুর ভাঁজছেন তো ভাঁজছেনই, গলা সাধছেন তো সাধছেনই, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। হয়তো বর্ষাকাল-- মেঘলা হয়েছে-- আমার তখন একটু কবিত্ব [জাগল]। তবু যা শুনতাম হয়তো মনে থাকত।...’

    বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট শিল্পী, যদুভট্ট, মারা যান মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সেই।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @